‘প্রত্যাবাসনে যোগ্য’ ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিল মিয়ানমার

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৩

প্রত্যাবাসনে যোগ্য রোহিঙ্গাদের তালিকা দিয়েছে দেশটি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই বাছাই করে প্রত্যাবাসনে যোগ্য বিবেচনায় ১ লাখ ৮০ হাজার জনের তালিকা দিয়েছে দেশটি।
বাকিদের বিষয়ে যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে।
এদিন থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউ প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সংকট ও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলী সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন- জানানো হয় সরকার প্রধানের দপ্তরের বার্তায়।
প্রত্যাবাসিত হতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের এই তালিকা প্রকাশকে এই সংকট সমাধানের পথে বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছে সরকার; যদিও মিয়ানমার চার বছর আগেও ৪২ হাজার জনের পরিচয় যাচাই বাছাই করে বাংলাদেশকে তালিকা দিয়েছিল, কিন্তু প্রত্যাবাসনের উদ্যোগে একাধিকবার হোঁচট খেতে হয় বাংলাদেশকে।
মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ‘প্রত্যাবাসনে যোগ্য’ রোহিঙ্গাদের তালিকা এর আগেও দেওয়া হয়েছে। তবে প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ একেবারে শেষ মুহূর্তে দুইবার ভেস্তে যায়। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেয়ে দেশে ফিরতে চায়নি রোহিঙ্গারা।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ছয় দফায় মিয়ানমারের কাছে ৮ লাখ রোহিঙ্গার একটি তালিকা হস্তান্তর করেছিল।
ওই তালিকা থেকে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাই করে তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তাদের নাম ও ছবির অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাকি ৫ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাই দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা হবে।
আশির দশক থেকেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকার মধ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে আশ্রয় নেয় আরও সাত লাখেরও বেশি। সে সময় সেনা অভিযানের মুখে পলায়নপর জনগোষ্ঠীর জন্য সীমান্ত খুলে দেয় প্রশংসিত হয়েছিল বাংলাদেশ। তাদের আশ্রয় হয় প্রধানত কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে।
সরকারি হিসাবে এই সংখ্যাটি ১২ লাখ ছাড়িয়ে যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের আঙ্গুলের ছাপ ও ছবি নিয়ে পরিচয়পত্রও দেওয়া হয়।
ওই আমলে একাধিকবার তাদের প্রত্যাবাসনের আলোচনা শুরু হলেও শেষমেশ তা ভেস্তে যায়।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে ২০১৭ সালের আগস্টের শেষে সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। সে সময় আন্তর্জাতিক আহ্বানের মধ্যে সীমান্ত খুলে দেয় বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নির্যাতনকে তখন ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী’ উদাহরণ হিসাবে বর্ণনা করেছিল জাতিসংঘ। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠার মধ্যে অনেকে একে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করে মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ওই বছর দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেয়ে বাংলাদেশ থেকে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।
প্রত্যাবাসন আটকে থাকার মধ্যে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির দ্বিতীয় দফার নতুন সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। গৃহযুদ্ধে সরকার টালমাটাল।
প্রত্যাবাসন আটকে থাকার মধ্যে সরকার কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ছয় দফায় প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তর করেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট তুমুল গণআন্দোলনে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিকে আবার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে গেছে।
গত ১৪ মার্চ কক্সবাজারের শিবিরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতার করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সেদিন তিনি তাদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথাও বলেন।
গত ১৪ মার্চ রোহিঙ্গা শিবিরে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে নিয়ে এক ইফতার আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তিনি আশা করেন রোহিঙ্গারা আগামী ঈদ তাদের নিজ দেশে করবেন।
৩১ মার্চ ঈদের দিন প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও পোস্ট করেও একই কথা লেখা হয়।
মার্চের শেষে চীন সফরে গিয়ে দেশটিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান ইউনূস, এই বিষয়ে জাতিসংঘে একটি বিশেষ অধিবেশনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে, যদিও এখন সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদেরকে বাধা দিচ্ছে।
বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে দেশটিতে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে বাংলাদেশ। সেখানে আরও মানবিক সহায়তা পাঠানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়।