Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

চলুন পাহাড়ের উৎসবে

Icon

তুষার ইশতিয়াক

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:২২

চলুন পাহাড়ের উৎসবে

কাপ্তাইয়ের চিৎমরমে মারমাদের জলোৎসব। ছবি: ঝুলন দও

রাঙ্গামাটির বড়ইছড়ি থেকে কাপ্তাইয়ের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটির এক পাশে রাম পাহাড় আরেক পাশে সীতা পাহাড়। কর্ণফুলী বয়ে গেছে সীতা পাহাড় ঘেঁষে। নদীর তীরেই বন বিভাগের রাম পাহাড় বিট অফিস। পাহাড়ের বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের এক উৎসবের সময় আস্তানা গেড়েছিলাম সেখানেই। 

গল্পটা দেড় যুগ আগের, ২০০৭ সালের। রাম পাহাড় বিট অফিস থেকে রাস্তায় উঠে এলাম আমরা কয়েকজন। তখন পাহাড়প্রেমী হয়ে উঠলেও সাংগ্রাই, বিজু- এসব সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার ছিল না। তাই যখন দেখলাম রাস্তার অপর পাশে বালতিভর্তি পানি নিয়ে মারমা নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে, কিছুটা অবাক হলাম। শিলছড়ি মারমা পাড়ারের বাসিন্দা তারা। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের শরীর ভিজে গেল পানিতে। অটোরিকশায় চেপে চিৎমরম যাওয়ার পথেও রাস্তার দু-পাশে অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম পানি হাতে। বারবারই উৎসবের এই জলে ভিজিয়ে দিলেন তারা আমাদের। জামা-কাপড় ভিজে গেলেও প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এই জলের ছিটা শরীরে আনন্দদায়ক একটা অনুভূতি এনে দিল। সেই সঙ্গে আমরাও হয়ে গেলাম তাদের একজন, পাহাড়িদের উৎসবের অংশ।

চিৎমরমের বিষয়ে কিছু বলার আগে বরং পাহাড়িদের এ উৎসব নিয়ে দু-চারটি তথ্য দেওয়া যাক। পাহাড়ে বর্ষবরণের এ উৎসব ত্রিপুরাদের কাছে বৈসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত। এ উৎসব বহু পুরোনো। ১৯৮৫ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করা চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে উৎসবটি পালন শুরু করে। অর্থাৎ বৈসুর বৈ, সাংগ্রাইয়ের সা এবং বিজুর বি। 

শুরুটা করেছিলাম ২০০৭ সালের গল্প দিয়ে। যাচ্ছিলাম চিৎমরম। জায়গাটি তখন এতটাই মোহাচ্ছন্ন করে যে পরে বারবারই গিয়েছি। কখনো নববর্ষে, কখনো প্রবারণা পূর্ণিমায়। গন্তব্যের কাছাকাছি, সেখানে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে কর্ণফুলীতে। রঙিন পোশাকে নানা বয়সী মানুষে ভরে গেছে নদীর তীর। বড় একটি অংশ মারমা। তবে চাকমা, ত্রিপুরা ও বাঙালিরাও আছে।

রাঙ্গামাটিতে বিজু উৎসবে পানিতে ফুল ভাসাচ্ছেন এক চাকমা তরুণী। ছবি: মিশুক চাকমা


চিৎমরম রীতিমতো বিখ্যাত এলাকা। মারমা অধ্যুষিত এলাকা বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বড় সাংগ্রাই উৎসবগুলোর একটি হয় এই চিৎমরমে। বিশাল মাঠের মধ্যে প্যান্ডেল, মঞ্চে মারমা ভাষার গান শুনে মুগ্ধ হবেন সন্দেহ নেই। আর সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করবে যেটা সেটা নিঃসেন্দেহে সাংগ্রাইয়ের জলকেলি। বলা চলে সাংগ্রাই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ এটি। কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে একে অপরের দিকে জল ছুড়ে দেয় তরুণ-তরুণীরা। এর মাধ্যমে পুরোনো বছরের সব দুঃখ-গ্লানি ধুয়ে-মুছে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় মারমারা। সাংগ্রাইয়ে পিঠা বানানো হয় ঘরে ঘরে, স্নান করানো হয় বৌদ্ধমূর্তিকে।

পাহাড়ে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরাও বিভিন্ন নামে উৎসব পালন করে। তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে এটি বিষু, ম্রোদের চাংক্রান পোয়ে, খুমিদের সাংক্রাই, খেয়াংদের সাংলান ও চাকদের সাংগ্রাইং।

বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন উদ‌যাপিত হয় চাকমাদের বিজু। বিজুতে চাকমা নর-নারীরা দলবেঁধে ঘোরাঘুরি করে। পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র মাসের শেষ দিন মূল বিজু। আগের দিন ফুল বিজু, আর পহেলা বৈশাখ পরিচিত গজ্জ্যাপজ্জ্যা পিজু হিসেবে। এদিন কেউ কোনো কাজ করে না, সবাই নতুন পোশাক গায়ে দিয়ে দলবেঁধে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।

চাকমাদের বিজুর সময় একবার রাঙ্গামাটিতে দারুণ আনন্দময় সময় কাটে। ফুল বিজুর দিন ভোরে রাঙ্গামাটিতে কর্ণফুলীর পারে হাজির হয়েছিলাম। চাকমা তরুণীরা ফুল ভাসিয়ে দিচ্ছিল জলে। এদিকে মূল বিজুর প্রধান আকর্ষণ ‘পাজন’। নানা সবজি দিয়ে তৈরি এ তরকারির স্বাদ এখনো জিবে লেগে আছে।পাহাড় এরই মধ্যে উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের মেলা শুরু হয়ে গেছে পার্বত্য জেলাগুলোতে। ৯ এপ্রিল থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত চার দিনব্যাপী নানা আয়োজন করেছে রাঙ্গামাটির বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু-বিষু-বিহু-সাংক্রাই-চাংক্রান-পাতা উদযাপন কমিটি। এখানে বলে রাখা ভালো, খিস্ট ধর্ম গ্রহণ করায় পাহাড়ের বম, পাংখোয়া ও লুসাইরা এই নববর্ষে সাধারণত নিজস্ব কোনো কর্মসূচি রাখে না।

চাকমাদের মতোই চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন উদযাপিত হয় ত্রিপুরাদের বৈসু। প্রথম দিন অর্থাৎ হারি বৈসুর দিনে ভোরবেলায় ফুলগাছ থেকে ফুল সংগ্রহ করা হয়। এই ফুল দিয়ে পুরো বাড়ি সাজানোর পাশাপাশি মন্দিরে দেওয়া হয়। বৈসুমা হচ্ছে দ্বিতীয় দিন এবং এদিন থাকে নানা খাবারের আয়োজন। বাড়িতে আসা অতিথিদের মিক্স সবজি বা লাবড়াসহ নানা খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

তৃতীয় দিন অর্থাৎ নতুন বছরকে বরণের দিনকে বলা হয় বিসিকাতাল। পরিবারের ছোটরা বড়দের পানি দিয়ে পা ধুয়ে প্রণাম করে। সবার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করা হয়। বৈসুর সময় ত্রিপুরারা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলায় অংশ নেয় এবং গরয়া নৃত্য পরিবেশন করে।  

বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উৎসবকে ম্রো সম্প্রদায় চাংক্রান উৎসব হিসেবে পালন করে। এ সময় বিভিন্ন পাড়া থেকে আসা দল অংশ নেয় ম্রো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বাঁশি নৃত্যে। ম্রো নারী ও পুরুষরা পুঁতির মালা তৈরি, কাপড় বোনা, লাঠি দিয়ে শক্তি প্রদর্শন ও ঐতিহ্যবাহী গো-হত্যা নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

আবারও বছর কয়েক আগে ফিরে যাচ্ছি। পাহাড়ের নববর্ষের উৎসবে তখন গিয়েছিলাম খাগড়াছড়িতে। মোট পাঁচজনের দল। আমার মেয়ে আর স্ত্রীর পরনে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। আগুনে গরমে অটোরিকশায় চেপে ঢুকে পড়েছিলাম সাংগ্রাইয়ের শোভাযাত্রায়। চারপাশ থেকে আসা জলের ছিটায় ভিজে একসা। আমার পাঁচ বছরের মেয়েও সমানতালে সদ্য কেনা ওয়াটার গান দিয়ে জল ছুড়ছিল মারমা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের দিকে। মারমারাও যেন তাদের একজনই ভাবছিল আমাদের। এমনকি ওর পানি শেষ হয়ে গেলে এক মারমা পানি ভরেও দিয়েছিল। তারপর গিয়েছিলাম খাগড়াছড়ির পাংখাইয়াপাড়ায়, প্রচণ্ড গরমে জলিকেলি উৎসবে অংশ নিয়ে জুড়িয়েছিলাম শরীর-মন।

পাঠক চাইলে এ বছরের নববর্ষটা পাহাড় ও অরণ্যময় তিন জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান বা খাগড়াছড়িতে কাটাতেই পারেন। ১২ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত থাকলে মোটামুটি সব জনগোষ্ঠীর উৎসবই পাবেন। এর মধ্যে চিৎমরমের এবারকার সাংগ্রাই ও জলকেলি উৎসব ১৫ এপ্রিল, তারপর যেতে পারেন কাছেরই আরেক জনপদ বাঙালহালিয়ায়, সেখানে মারমাদের উৎসব ১৬ এপ্রিল। এদিকে খাগড়াছড়ির পানখাইয়াপাড়ার জলকেলি উৎসব হবে পহেলা বৈশাখের দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল। ম্রোদের উৎসব দেখতে চাইলে যেতে পারেন চিম্বুকের আশপাশের ম্রো পাড়াগুলোতে। তবে এ সময় সূর্য অকৃপণভাবে তাপ ঝরায়, তাই ছোট ছেলেমেয়ে বা বয়স্করা সঙ্গে থাকলে বাড়তি সতর্কতা জরুরি। তেমনি পাহাড়ের মানুষের উৎসব উপভোগের সময় তাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫