যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে এনবিআরের নানা উদ্যোগ

আল আমিন
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৬

রাজস্ব ভবন। ফাইল ছবি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর নতুন শুল্কনীতি বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ওপর কেন্দ্রীভূত। তবে বিশ্বজুড়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুল্কের খড়গ চাপিয়েছেন, তার ধাক্কা সামলাতে হবে মার্কিনদেরও। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যেসব দেশ থেকে নিয়মিত পণ্য কিনে থাকে, সেসব দেশের প্রায় সবাই দেশটিতে রপ্তানি করা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে পোশাক থেকে শুরু করে কফি- সবকিছুতেই বাড়তি অর্থ গুনতে হবে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করেছে ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য এবং আমদানি করেছে ২২০ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২০ কোটি ডলার। যদিও মার্কিন পণ্যের ওপর বাংলাদেশ কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, সেটি তারা বিবেচনায় নেয়নি। বরং এখানে শুধুমাত্র বাণিজ্য ঘাটতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মোট ২২০ কোটি ডলারের আমদানির মধ্যে ১২০ কোটি ডলার পণ্যের ওপরই কোনও শুল্ক নেই।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রায় এক ডজন পণ্য নির্বাচন করেছে, যার ওপর আমদানি শুল্ক কমানো যেতে পারে। তবে তারা এও মনে করছে, কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলে আমদানি নাও বাড়তে পারে, যদি না বেসরকারি খাত আমেরিকান বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক হয়। তাই বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে সরকারি ক্রয় একটি বিকল্প হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত আছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বাংলাদেশের পণ্যে। এই বাস্তবতায় রপ্তানি পণ্যের শুল্ক হ্রাস করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতে ৫০ শতাংশ শুল্কছাড়ের প্রস্তাব দেওয়ার চিন্তা করছে বাংলাদেশ।
এ ছাড়া যেসব পণ্যে এরই মধ্যে শুল্ক নেই, সেসব পণ্য বিনা শুল্কে আমদানি করার নীতি অব্যাহত রাখার চিন্তাও আছে। সেই সঙ্গে (৭ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বর্ধিত শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা এবং মার্কিন পণ্য বেশি পরিমাণে আমদানির বিষয়ে আলোচনার জন্য চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজস্ব কর্মকর্তা সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘আমরা কিছু মার্কিন পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলেও আমদানি নাও বাড়তে পারে, যদি না বেসরকারি খাত আমেরিকান বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক হয়। বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে সরকারি ক্রয় একটি বিকল্প হতে পারে।’
শুল্কবাধা অপসারণের পাশাপাশি অশুল্কবাধা অপসারণের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের কটন বা সুতা আমদানির ক্ষেত্রে ফিউমিগেশনের শর্ত বাতিল করা, যুক্তরাষ্ট্রের সুতা গুদামজাত করার অনুমতি দেওয়া, মার্কিন কৃষি ও প্রযুক্তিপণ্য কেনায় অগ্রাধিকার দেওয়া ইত্যাদি। একই সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কোম্পানি, অর্থাৎ ফরচুন ৫০ তালিকাভুক্ত কোম্পানি, যেমন- ওয়ালমার্ট, শেভরন, মেটা, টেসলা ও বোয়িংয়ের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা যায় এমন সম্ভাব্য চারটি পণ্যের নামও দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো ক্যালসিয়াম কার্বনেট, তাজা অথবা হিমায়িত পশুর মৃতদেহ (মাংসের জন্য), হাড়সহ পশুর মাংসের তাজা বা হিমায়িত টুকরা, হাড়বিহীন তাজা ও হিমায়িত পশুর মাংস।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এরই মধ্যে বেশ কিছু মার্কিন পণ্য বিনা শুল্কে আমদানি করছে। সেগুলো হলো কটন বা সুতা, ভাঙা বা আস্ত সয়াবিন, তরলীকৃত বিউটেনাস, সমুদ্রগামী জাহাজ ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস।
এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্য দেশের রাজস্ব আদায়ে মোট শুল্ক আহরণের ৩ শতাংশের মতো।
এনবিআরের তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম ৯ মাস (জুলাই-মার্চ) পর্যন্ত মার্কিন পণ্য আমদানি থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা, যা এই সময়ের মধ্যে সব আমদানি থেকে সংগৃহীত মোট শুল্ক করের ২ শতাংশেরও কম।
বাংলাদেশ এই ৯ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে, যার মধ্যে এই আমদানি থেকে মোট কর আদায় হয়েছে এক হাজার ১০ কোটি টাকা। বিপরীতে এই সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী আমদানি থেকে মোট রাজস্ব ৬৪ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) একই অবস্থা ছিল, এ সময় সর্বমোট ৩৪ হাজার ২৮ কোটি টাকার মার্কিন পণ্য আমদানি থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা, যেখানে মোট রাজস্ব ছিল এক লাখ ৮১৯ কোটি টাকা, যা আমদানি শুল্ক থেকে বাংলাদেশের মোট আয়ের প্রায় ১.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ অর্থবছরে দেশটির আমদানি পরিশোধ ছিল সাত লাখ দুই হাজার ২৩০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২৮ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল, যা বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানির মাত্র ৪ শতাংশ প্রতিফলিত করে। ২০২৩ অর্থবছরে মার্কিন আমদানি থেকে আদায় করা কর ছিল এক হাজার ৩১৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই হাজার ২০০টিরও বেশি পণ্য আমদানি করেছে, তবে এর মধ্যে মাত্র ১০টি পণ্যের কর রাজস্ব ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা মার্কিন আমদানির ওপর গড় শুল্ক বর্তমানে প্রায় ৩ শতাংশ দাবি করে বলেন, ‘যদি আমরা সম্পূরক এবং নিয়ন্ত্রক শুল্কের মতো অন্যান্য শুল্ক অন্তর্ভুক্ত করি, তাহলে গড় শুল্ক ৩.৫ শতাংশের কাছাকাছি হবে।’
তিনি আরো বলেন, তুলা, সয়াবিন, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম পণ্যসহ বেশ কিছু মার্কিন পণ্যের জন্য শূন্য শুল্ক সুবিধা রয়েছে।
এই রাজস্ব কর্মকর্তার মতে, যেহেতু বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ওপর কেন্দ্রীভূত, তাই তারা প্রায় একডজন পণ্য নির্বাচন করেছে, যার ওপর আমদানি শুল্ক কমানো যেতে পারে।
‘আমরা কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলেও আমদানি নাও বাড়তে পারে, যদি না বেসরকারি খাত আমেরিকান বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক হয়। বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে সরকারি ক্রয় একটি বিকল্প হতে পারে’ তিনি যোগ করেন।
বেসরকারি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক আমেরিকান পণ্যের ওপর বাংলাদেশ ৭৪ শতাংশ শুল্কারোপের ওয়াশিংটনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের পারস্পরিক শুল্ক আরোপ সম্পূর্ণরূপে অবৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক এবং পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ।’
কেবল শুল্ক কমিয়ে বাংলাদেশে মার্কিন রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে না বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদন খাতে প্রতিযোগিতামূলক খেলোয়াড় নয়, কেবল শুল্ক কমিয়ে আমদানিতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো খুব কঠিন।’
একতরফা ছাড় দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সব দেশের জন্য একটি শুল্ককাঠামো রয়েছে। আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যতিক্রম করি, তাহলে ভারত ও জাপানের মতো অন্যান্য দেশও একই অগ্রাধিকারমূলক আচরণ দাবি করতে পারে।’
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও একই মতামত প্রদান করে বলেন, ‘শুল্ক উদারীকরণের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির ওপর যদি শুল্ক হ্রাস করা হয় তবে তা উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ক্ষতির কারণ না হলেও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) নিয়মাবলির কারণে এই পদ্ধতিটি সমস্যাযুক্ত হতে পারে। এটি ইউরোপীয় ও এশীয় অংশীদারদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করতে পারে।’