
ইয়াংওয়ানের চেয়ারম্যান কিহাক সাংয়ের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব সনদ দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশের পোশাকশিল্প যখন একটু একটু করে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, সে অগ্রযাত্রায় বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রথম বিনিয়োগকারী দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক কিহাক সাং। যিনি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান করপোরেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের শিল্প খাতের বিকাশ ও বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, বৈদেশিক আয়ে সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে অবদান রাখায় কিহাক সাংকে গত ৯ এপ্রিল সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে সাংয়ের হাতে এই স্বীকৃতি তুলে দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
সাংয়ের বয়স এখন ৭৮। অর্ধেকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে এক আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছেন তিনি। গত শতাব্দীর আশির দশকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প কোটামুক্ত সুবিধা পেত। এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে ১৯৮০ সালের মে মাসে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন কিহাক সাং। ১৯৭৯ সালেও তিনি কয়েক দফায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। তবে কারখানা করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন ১৯৮০-তে। বাংলাদেশি কয়েকজন অংশীদার নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইয়াংওয়ান বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামের কারখানা। শুরুতে তাদের এই কারখানায় শ্রমিক ছিল দুই শতাধিক। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে অভিজ্ঞ লোকজন এনে এই কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশের অংশীদারদের থেকে আলাদা হয়ে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) নিজস্ব কারখানা স্থাপন করেন। বর্তমানে কিহাক সাংয়ের হাতে গড়া ইয়াংওয়ান করপোরেশনের বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায় ৭৩ হাজারের বেশি মানুষ কর্মরত রয়েছেন। একমাত্র বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে ব্যক্তি উদ্যোগে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় গড়ে তোলেন কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (কেইপিজেড)। এটি পরিচালিত হয় ইয়াংওয়ান করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে। এখানে ইয়াংওয়ানেরই রয়েছে ৪৮টি কারখানা। এ কারখানাগুলোর বেশির ভাগই পোশাক খাতের। পোশাকের বাইরেও জুতা ও ব্যাগ তৈরির কারখানাও রয়েছে। কেইপিজেডের বাইরেও বেশ কিছু কারখানা রয়েছে ইয়াংওয়ানের। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৮৬ কোটি ২৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ইয়াংওয়ান করপোরেশন। এর মধ্যে ছিল ৮০ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের পোশাকপণ্য। পোশাকের বাইরে জুতা, ব্যাগসহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বাকি পাঁচ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। বাংলাদেশ থেকে ইয়াংওয়ানের প্রায় ৮৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির মধ্যে ৩৮ কোটি ডলারই এসেছে কেইপিজেড থেকে। কেইপিজেডের সব কারখানা আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ও পরিবেশবান্ধব। আড়াই হাজার একরের কেইপিজেডের অর্ধেকের বেশি বা ৫২ শতাংশ জায়গাজুড়ে রয়েছে বন ও জলাধার। কেইপিজেড এলাকায় শ্রমিকদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ১০০ শয্যার হাসপাতাল। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া, উজবেকিস্তান, এল সালভাদর ও কোরিয়ায় কারখানা রয়েছে ইয়াংওয়ান করপোরেশনের।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড PUMA, adidas, The North Face-সহ জনপ্রিয় সব প্রোডাক্টের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কিহাকে ইয়াংওয়ান করপোরেশন। কিহাক সাং বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনতেও কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সম্মেলনে দক্ষিণ কোরিয়ার আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধিদল এসেছে।
কিহাক সাং নিজ উদ্যোগে এই বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ সফরে নিয়ে এসেছেন। সফরকারী বিনিয়োগকারীদের দলটি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে, সেখানে তারা বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
কিহাক সাংকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদানের এই ভাবনাটি কীভাবে এসেছে, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার
উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘কিহাক সাংকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদানের ধারণাটি নিয়ে প্রথম আলোচনা হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে চীনের হাইনানে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও কোরিয়ার নাগরিক বান কি মুন ‘বিওএও’ ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, সাং-যিনি এই দেশকে হৃদয়ে ধারণ করেছেন এবং কোরিয়ান ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলাদেশকে আপন করে তুলেছেন, তাকে সম্মানিত করার কোনো পরিকল্পনা বাংলাদেশের আছে কি না? এরপরই প্রধান উপদেষ্টা অবিলম্বে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সাংকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দেন। আজাদ মজুমদার আরো লিখেছেন, সাং বাংলাদেশের জন্য যা করেছেন খুব কম বিদেশি বিনিয়োগকারীই তা করেন।’
কোরিয়ান নাগরিক কিহাক সাংয়ের যাত্রাটা ছিল খুবই সাধারণ। কোরিয়ায় তার বাবার ছিল কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসা। তরুণ বয়সেই কিহাক ঠিক করেন, কর্মজীবনে তিনি বাবার সেই ব্যবসায় যোগ দেবেন না। শিক্ষাজীবন শেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথা অনুযায়ী, তিনি দেশটির সেনাবাহিনীতে ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে মাত্র ২৫ বছর বয়সে দেশটির একটি পোশাক কারখানায় বিক্রয় নির্বাহী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বিক্রয় নির্বাহী হিসেবে পোশাক খাতে কাজ করতে গিয়ে এ খাতের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে যান। কাজের সূত্রে পরিচয় হয় বিদেশি অনেক ক্রেতার সঙ্গে। জানতে পারেন খুঁটিনাটি নানা বিষয়। সাংয়ের এ যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগে যখন তিনি ১৯৭৪ সালে দুজন অংশীদারের সঙ্গে ইয়ংওয়ান করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। সিউলের উপশহরে প্রতিষ্ঠিত সে কারখানার পর কিহাক সাংকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার পরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাওয়ার।
কিহাক সাং ১৯৭৫ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। তিন মেয়ের জনক তিনি। এর মাঝে দ্বিতীয় মেয়েকে নিজের উত্তরাধিকার করেছেন। ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলেও পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভোলেন না কিহাক সাং। ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধব, ভাই-বোনদের নিয়ে সিউলের বাসায় বা গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে এখনো আড্ডা জমে তার।