সংস্কার: নারী যৌনকর্মীদের স্বীকৃতি চায় কমিশন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ২২:১৯

বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে ধারণা নেই। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন মনে করছে, তাদের পেশার স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী বিষয়ক সংস্কারের যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তাতে নানা বিষয়ের পাশাপাশি যৌনকর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি ও তাদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।
নারীর নিরাপত্তা, তার বিকাশ, কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বিষয়ে মোট মোট ১৭টি অধ্যায়ে ৪৩৩টি সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
এর মধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান নিয়ে প্রস্তাবে যৌনকর্মীদের বিষয়ে উল্লেখ আছে। এতে বলা হয়েছে, “অনানুষ্ঠানিক খাতে নারী শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা প্রয়োজন।… যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
“সরকারি ও বেসরকারি খাতে কার্যকর নজরদারি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে নারীদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।” সুপারিশমালার তৃতীয় অধ্যায়ে সংবিধান ও আইনগত কাঠামো সংস্কারের অংশ হিসেবে যৌনকর্মীদের অধিকারের বিষয়ে লেখা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, “যৌন পেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা।”
শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এই প্রতিবেদন জমা দেয়।
কমিশন বলেছে, সুপারিশ প্রণয়নে বিভিন্ন আর্থসামাজিক খাতের নারীর অবস্থা ও অবস্থান বিশ্লেষণ করে ১৭ টি অধ্যায়ে তা লিপিবদ্ধ করেছে।
প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, “আমাদের আশা এই সকল অধ্যায়ের সন্নিবেশিত সুপারিশমালা বর্তমান ও ভবিষ্যতে সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে এবং বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন একটি ঐতিহাসিক সুযোগ যা নারীর চাওয়া পাওয়াকে আলোচনা সমালোচনার মধ্য দিয়ে জাতি ও নীতি নির্ধারকের কাছে পরিচিত করবে।”
যৌনকর্মীদের স্বীকৃতির এই সুপারিশে সন্তোষ জানিয়ে যৌনকর্মীদের সংগঠন সেক্সওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি আলেয়া আক্তার লিলি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “সারাদেশের যৌনকর্মীদের সবচেয়ে বড় দাবি ছিল আমাদের পেশার স্বীকৃতি পাওয়া।”
এই স্বীকৃতি না দেওয়া সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, “সংবিধানে বলা আছে, বয়স ১৮ বছর হলে যে কোনো মানুষ যে কোনো পেশা বেছে নিতে পারে। কিন্তু অন্যান্য মানুষ যেভাবে তাদের অধিকার আদায়ে সস্পৃক্ত হতে পারে, আমরা যৌনকর্মী হিসেবে আমরা কোনো অধিকার পাই না। যদি আমরা আমাদের পেশার স্বীকৃতি পাই, সাধারণ মানুষের মতো অন্যান্য অধিকার পাব।”

এই স্বীকৃতির অভাবে কী সমস্যা হচ্ছে, তাও তুলে ধরেন আলেয়া। বলেন, “যৌনকর্মীর ছেলে-মেয়েরা ভালো স্কুলে পড়ালেখার সুযোগ পায় না। তারা বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না। পেশার স্বীকৃতি পেলে তারা হয়ত সেটা পারবে।”
বাংলাদেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা মোট কত, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা নেই। ২০১৪ সালে সরকারি এক প্রতিবেদনে সংখ্যাটি ১ লাখ ২০ হাজার বলে উল্লেখ ছিল।
তবে এই পেশায় জড়িত অনেকেই তাদের কাজের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনতে চান না, সেই হিসাবে আসলে কত মানুষ যৌন পেশায় জড়িত, সেই ধারণা পাওয়া সম্ভব না।
আলেয়া অবশ্য বলেছেন, তাদের হিসাবে দেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা এক লাখেরও বেশি।
নারীর স্বাস্থ্য নিয়েও বিশেষভাবে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছে সংস্কার কমিশন।
“শুধু তার প্রজনন ভূমিকার জন্য নয় তার জীবন চক্র জুড়ে বিবেচনা করা উচিত।”
নারীর লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার বলে মত দিয়ে প্রতিবেদনে লেখা হয়, এটি নিজ ঘরেও বিদ্যমান।
প্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন নিয়ন্ত্রণে ২০২৩ সালের উচ্চ আদালতে নির্দেশনা অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা জরুরি বলেও সংস্কার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন হাতে পেয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যেসব সুপারিশ এখনি বাস্তবায়নযোগ্য তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন।
“আমরা যেন এই কাজের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি” বলেন তিনি।

শনিবার নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে সংস্কার প্রতিবেদন তুলে দেয়।
সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, “সুপারিশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।কিছু এ সরকারই করে যেতে পারবে, কিছু পরের নির্বাচিত সরকার করতে পারবে এবং নারী আন্দোলনের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে।”
নারী ব্যাপক বৈষম্যের স্বীকার
কমিশনের প্রতিবেদনে নারীর শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ে সুপারিশে বলা হয়েছে, “নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বাড়লেও তারা এখনও ব্যাপক বৈষম্য ও সমস্যার শিকার। কর্মজীবী নারীদের ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যেখানে ন্যায্য মজুরি, প্রসূতি ও প্রসবজনিত ছুটি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়।”
পোশাক শিল্পে যান্ত্রিকীকরণের ফলে শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে বলে মত দিয়ে এতে লেখা হয়, “নারীরা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, সহিংসতা ও বৈষম্যের মুখোমুখি হন, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। সব কাজে সমমজুরি না পাওয়ার পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও দিবাযত্ন সুবিধার অভাব নারীদের কর্মজীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নারীদের দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সীমিত উল্লেখ করে এতে “যা ভবিষ্যতে তাদেরকে আরও পিছিয়ে দেবে।”
নারীর শ্রমশক্তির প্রতি বৈষম্য কমাতে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশও করেছে কমিশন। সব খাতেই নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা, সেটি বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি বছর পুনর্মূল্যায়ন করা এবং ‘বাঁচার মতো মজুরি’র জন্য নীতি নির্ধারণ করতেও বলা হয়েছে।
শ্রম আইন সংশোধন করে প্রসূতি ও প্রসবজনিত ছুটি ছয় মাসে উন্নীত করা ও পিতৃত্ব সম্পর্কিত ছুটি চালুর পরামর্শও দিয়েছে কমিশন।
কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন ও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কার্যকর কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক করতেও বলা হয়েছে।
শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি, ট্রেন ইউনিয়নে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার-সংবেদনশীল পরিবেশ তৈরি ও নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি বলেও মত দিয়েছে কমিশন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৮২ সালে গৃহীত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সদন-সিডোর বিষয়ে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের সুপারিশও করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। তারা আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব সংলক্ষণ প্রত্যাহারেরই পক্ষে।
নারীর জন্য সহিংসতা প্রকট সমস্যা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নারীর উপর সহিংসতা একটি প্রকট সামাজিক সমস্যা। সকল বয়সের, সকল শ্রেণি-পেশার নারীই সর্বদা সহিংসতার ঝুঁকি ও আতঙ্কে থাকে।

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
নারীর উপর সহিংসতার সূত্রপাত নারীর প্রতি বৈষম্যের গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে শুরু হয় বলে মন্তব্য করে এতে লেখা হয়েছে, “ধর্ম,প্রথা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর প্রতি বৈষম্যের মূল কারণ।”
“এ অবস্থাকে আরো জোরদার করেছে বৈষম্যমূলক আইন। ঘরে, বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যুদ্ধক্ষেত্রে, দুর্যোগে-দুর্বিপাকে এমনকি প্রতিনিয়ত আনন্দানুষ্ঠানেও নারী যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ফলে নারীর অগ্রগতি, বিকাশ ও জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে এবং নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”
নারী ও মেয়ে শিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ নির্মাণে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের সমন্বয়ে নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও যথাযথ সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০৩০ পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করা, এর বাস্তবায়নের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ও বাজেটে খাতওয়ারি সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নারীর কর্মক্ষেত্র ছাড়াও নারীর অগ্রগতির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, নারীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন, নারী ও মেয়ে শিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ, জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণসহ নানা সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।