Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

Icon

পাভেল পার্থ

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৩

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

সুন্দরবন অঞ্চলের মুণ্ডা আদিবাসীদের সুরুলপূজা। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

গ্রামীণ নিন্মবর্গের বর্ষপঞ্জিকা প্রাণ ও প্রকৃতির নির্দেশনাকে মেনেই গড়ে তুলেছিল নানা কৃত্য ও বার্ষিক আয়োজন। সংক্রান্তি হলো বর্ষপঞ্জিকার এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। প্রতি মাসের শেষ হলো সংক্রান্তি আর প্রতি মাসের শুরু হলো মাস-পয়লা। ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনে সমাজকে প্রস্তুত করার সব আয়োজন গড়ে উঠেছিল এ সময়টাতেই। এর ভেতর আবার চৈত্রসংক্রান্তি, ফাল্গুনসংক্রান্তি, পৌষসংক্রান্তি, ভাদ্রসংক্রান্তি, শ্রাবণসংক্রান্তি, কার্তিকসংক্রান্তির আয়োজন পার্বণময়। কারণ এ সময়গুলো মাস নয়, বদলে যায় প্রকৃতির ঋতুকাল। চলতি আলাপে আমরা বাঙালি ও আদিবাসী জীবনের অসুখ ও মহামারি সামাল দেওয়ার সংক্রান্তিগুলো নিয়ে কথা বলব। আলাপের কেন্দ্রে রাখব বর্ষবিদায়ের সংক্রান্তিপর্বগুলো। কারণ এই সময়ে সমাজ পরবর্তী ৩৬৫ দিনের জন্য সামগ্রিক প্রস্তুতি নেয় শরীর ও মনে। আর এখানেই চৈত্রসংক্রান্তির শক্তি এবং প্রকৃতি পাঠের এক অনন্য সমন্বয়। 

চৈত্রসংক্রান্তি ও চইতপরব

প্রকৃতিতে তিতা জাতীয় শাকের উপস্থিতি জানান দেয় চৈত্র মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, বৈশাখ সমাগত। এটি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সন্ধিস্থলের এক অনন্য চিহ্ন। তিতা শাক ছাড়া বাঙালি কি আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায়ের সংক্রান্তি কৃত্য হয় না। গিমা তিতা, নাইল্যা, গিমা, দণ্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিম, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ ও কানশিরা- এ রকমের ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। আদিবাসী বেদিয়া-মাহাতোরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটাখুঁড়ে, গিমাসহ নানা জাতের তিতা শাক খায়। হাওরাঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির দিন আয়োজিত এ কৃত্যের নাম ‘বেগুন পাতার বর্ত’। হাওরাঞ্চলে ব্রতকে ‘বর্ত’ বলে। এ দিনটিকে অনেকে ‘হার বিষুও’ বলেন, কেউ বলেন ‘চইত পরব’। চইত পরবে বর্তের আগ পর্যন্ত বাড়ির নারীরা উপবাস থাকেন। ভোর রাতে উঠে বাড়িঘর সাফসুতরো ও লেপামোছা করতে হয়। বেগুনপাতার বর্তের জন্য বাড়ির বিছরাক্ষেতের (আঙিনা বাগান) বেগুনগাছ থেকে ৫-১৩টি পাতা সংগ্রহ করা হয়। পাতাগুলো ধুয়ে ১৩টি পাতায় ১৩ জাতের তরিতরকারি রান্না করে ভাতসহ দেওয়া হয়। বর্ত শেষে বেগুনপাতাগুলো নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

চাকমারা এ সময় আয়োজন করে বিজু। ফুল বিজু, মূল বিজু ও গয্যাপয্যার দিন এই তিন পর্বে বিভক্ত বিজুর মূলে থাকে নানা পদের পাহাড়ি শাক-সবজির তৈরি পাজোন। বান্দরবানের চাকরা সাংগ্রাইংয়ের সময় কাইনকো বা নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহে মুখরিত হয়ে ওঠেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ সময় বিষু আয়োজন করে। মারমা ও রাখাইনরা সাংগ্রাই আয়োজনে পবিত্র জল দিয়ে আগত সবাইকে ভিজিয়ে শুদ্ধ করেন। চৈত্রসংক্রন্তির আরেক অনবদ্য চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো গাজন বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরি সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। আয়োজনে বৈচিত্র্য থাকলেও চৈত্রসংক্রান্তির মূলে আছে সুস্থতার জন্য প্রকৃতির তিতারস গ্রহণ ও চারপাশের পরিচ্ছন্নতা। 

চৈত্রসংক্রান্তির দেল পরবে কুমিরের কাছে প্রার্থনা করা হয় গ্রামের শান্তি ও মঙ্গলের জন্য।


হাজরা ও বাইশাখী

রবিদাসদের ভেতর বাইশাখী পূজা ও হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। মৌসুমি ফল আমকে বর্ষবিদায়ের এ রীতির ভেতর দিয়েই সমাজ গ্রহণ করে রোগব্যাধি সামাল দেওয়ার জন্য। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্রস্থলে কর্মের পূজা করা হয়। রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সঙ্গে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো দেওকুড়িতে রাখে। কেবল মানুষ নয়, এ সময় পেশায় জড়িত সব উপকরণ ও গৃহস্থালি ধোয়ামোছা করতে হয়। 

চইতবিশমা

দিনাজপুরের বিরলের কড়া আদিবাসীরা চৈত্রসংক্রান্তিতে আয়োজন করেন চইতবিশমা। সংক্রান্তির কয়েক দিন আগ থেকেই পাড়াগ্রাম পরিচ্ছন্ন করা হয়, বহিরাগতদের গ্রামে প্রবেশ সীমিত করা হয়। চইতবিশমার দিনে নিমপাতার কাঁচা রস ও নানা পদের তিতাশাক খাওয়া হয়। পেঁয়াজ-রসুন-শুকনো মরিচ ঝুলানো হয় ঘরের দরজায়। 

বাহা

ফাগুন (ফাল্গুন) মাস থেকেই শুরু হয় সাঁওতালি বর্ষ। বর্ষবিদায় ও বরণের উৎসব বাহাও পালিত হয় এ মাসেই। এ সময় গাছে গাছে সারজম, ইচৗক, মুরুপ আর মহুয়া ফুল ফোটে। বাহা পরবের ভেতর দিয়েই সাঁওতাল সমাজ এসব ফুলের মধু পান ও ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করে প্রকৃতির কাছে। বাহার আগে এসব ফুলের ব্যবহার সামাজিকভাবে নিষেধ। বাহা পরবে রোগজরা নিরাময়ে নতুন ফুলের স্পর্শ গ্রহণের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করে সাঁওতাল সমাজ।

হেচড়া

গোপালগঞ্জ-মাদারীপুরের চান্দারবিল এলাকায় হেচড়া দেবী পূজিত হন বসন্তকালে খোস-পাঁচড়া, বসন্ত, চুলকানি নিরাময়ের মানতে। এদিনে গো-ফাল্গুন রীতিও পালন করা হয়। গোবরের দলায় বউন্যা ও ভাটির (ভাঁট) ফুল গেঁথে দিয়ে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় ফাল্গুন মাসে এবং কোথাও কোথাও চৈত্রসংক্রান্তিতে এ কৃত্য পালিত হয়।

পঞ্চমদোল

ফাল্গুনসংক্রান্তিতে আয়োজিত পঞ্চমদোল উৎসব বেশ কয়েকটি পর্ব ও আচারকৃত্যে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলে। প্রথম দোলভিটে মেরামত, তারপর দোলপূর্ণিমার প্রথম দিন কুড়া পোড়ান পর্ব, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন দোলপূজা, চতুর্থ দিন হোলি, পঞ্চম দিন পুণ্যাহ বা সমাপ্তি। গ্রাম থেকে অশান্তি, রোগশোক ও অশুভ শক্তিকে দূর করার জন্য এই কৃত্য পালিত হয়।

শীতলাপূজা

বসন্ত রোগবিনাশী দেবী শীতলা। ফাল্গুন-চৈত্রে আয়োজিত শীতলাপূজা ঘিরে নরসিংদী, গাজীপুর, মৌলভীবাজার, সিলেট, সাতক্ষীরাসহ দেশের নানাপ্রান্তেই জমে ওঠে ভিন্ন রকম আয়োজন ও মেলা। 

শীতলাপূজায় ১০৮টি মাটির ছোট প্রদীপ লাগে। একটি দেবী ঘট, একটি ফুল-জলের হাঁড়ি লাগে। এতে দুধ-বাতাসা-বেলপাতা-তুলসীপাতা-ডাবের জল মেশানো হয়। পূজার পরে সবাইকেই এটি খেতে দেওয়া হয়। কেউ কেউ এটি শরীরে মাখেন। শেষে হোমযজ্ঞের কালি ও ঘি একত্রে মিশিয়ে সবার মাথা-কপালে লাগানো হয়। সাতক্ষীরার সুন্দরবন অঞ্চলে প্রতি বছর মানুষের হাম-বসন্ত-পাতলা পায়খানা-জ্বর হলে এবং গরু-ছাগলের গায়ে গুটি বের হলে, সর্দি লাগলে শীতলাপূজার মানসী (মানত) করা হয়। 

সারুল

অসুখ ও অশুভশক্তি থেকে গ্রামকে মুক্ত রাখতে বসন্তকালে মুণ্ডারা পালন করে সারুল/সারহুল কৃত্য। সুন্দরবন অঞ্চলে এ পূজায় সিন্ধ্রি (সুন্দরী) গাছের পাতা লাগে। মাটির থানে ও ঘরের ভেতর পূজা হয়। কৃত্যের সময়ে কঠোরভাবে বহিরাগতদের গ্রামে প্রবেশ সীমিত করা হয়। 

ঘাটাবান্ধাবর্ত

হাওরাঞ্চলে বসন্তকালীন রোগব্যধি থেকে মুক্ত থাকতে এই ব্রত পালিত হয়। চালতাপাতা দিয়ে ঘাটা বাঁধা হয় এবং ঘরবাড়ির চারপাশ, জমিন ও গৃহে প্রবেশের মুখে এসব স্থাপন করা হয়, যেন কোনো ব্যাধি ও অশুভ কিছু প্রবেশ না করতে পারে। একইভাবে কমপক্ষে আট রকমের শাক-সবজি দিয়ে আটআনাজবর্তও পালিত হয় যাতে মানুষের শরীরে কোনো জরাব্যাধি প্রবেশ না করতে পারে। 

সংক্রান্তির শক্তি

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুর সন্ধিক্ষণ হলো সংক্রান্তি। খাদ্য থেকে শুরু করে চারপাশের পরিচ্ছন্নতা, সাময়িক বিচ্ছিন্নতা থেকে নানামুখী সঙ্গনিরোধ এসব মিলিয়েই আমাদের সংক্রান্তি আয়োজন। সংক্রান্তি কেবল গাজনের গীত বা তিতা শাকের পরব নয়। মহামারি থেকে বাঁচার এক সামষ্টিক স্থানীয় কায়দা। প্রকৃতিকে জানাবোঝার জন্য এক সামাজিক আহ্বান। 

মূলত এর ভেতর দিয়ে সমাজ জানাতে চায় প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু করণীয় ও বিধি আছে। এসব বিধিগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতেই সংক্রান্তির নানা কৃত্য আয়োজন। বাঙালি জনপদে চৈত্র মাসে শিমুইর (শিম), ফাল্গুনে মুলা, শ্রাবণে কচু, আষাঢ়ে ওল, জ্যৈষ্ঠে গিমাতিতা শাক, কার্তিকে ওল খায় না অনেকেই। গ্রামের প্রবীণ অনেকেই এখনো মনে করেন বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসে কোনো শস্য ফসল লাগাতে হয় না, কারণ এতে জ্যেষ্ঠ সন্তানের অমঙ্গল হয়। শ্রাবণ মাসে কলাগাছ লাগানোর নিয়ম নেই। শ্রাবণ মাসে মনসাবর্ত হয় এবং এর সঙ্গে জড়িত বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনিতে বেহুলা কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে ছিল বলেই শ্রাবণ মাসে কলাগাছ পোঁতার নিয়ম নেই। শনি ও মঙ্গলবারে কোনো শস্য বপনের নিয়ম নেই। ত্রিসন্ধ্যা, সন্ধ্যা, রাত ও ভোর রাতে কোনো কিছু লাগানোর নিয়ম নেই। সমতল অঞ্চলের বাঙালি মুসলিম পরিবারের অনেকেই বুধবারে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটে না, কারণ তারা বুধবারকে মাদারিয়া বার হিসেবে দেখে। মাদার পীরের বারকে মাদারিয়া বার বলে। টাঙ্গাইলের চারাণ বিলের বাঙালি জেলে পরিবারে রাগা মাছ খাওয়া হয় না। অনেকে বিশ্বাস করেন এই মাছ সর্পদর্শনের পর ভেলায় ভাসমান লক্ষিন্দরের পায়ের টাখনুগিরা খেয়ে ফেলেছিল। ঠিক যেমন সিলেটসহ দেশের অনেক অঞ্চলের বাঙালি মুসলিম পরিবার হজরত শাহজালালের স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জালালি কবুতরের মাংস খান না। কিন্তু আমাদের তথাকথিত আধুনিক ও ‘সভ্য’ শহুরে সমাজে প্রতিদিন প্রকৃতির ব্যাকরণকে অমান্য ও তছনছ করা হয়। আমাদের নাগরিক জীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখন সারা বছর বাজারমুখী ফসল মেলে। কোনো কিছু দেখে বোঝার উপায় নেই, এটা কোন ঋতু। আমরা প্রকৃতির ধারাপাত চুরমার করে দিচ্ছি বলেই ইবোলা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনাসহ নানা মহামারিতে দুনিয়া বিপর্যস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের গ্রামীণ নিন্মবর্গের সংক্রান্তি পালনের ভেতর প্রকৃতির বিজ্ঞানকে মান্য করার এক অবিস্মরণীয় শক্তি ও দর্শন আছে। ব্যক্তি নয়, সমষ্টির অভিজ্ঞতা আর প্রকৃতির প্রতি নতজানু হওয়ার ভেতর দিয়েই সব সংকট থেকে মুক্তির জন্য লড়েছে নিন্মবর্গ। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের পরবগুলোও সেই শক্তিই জানান দেয়। 

গবেষক ও লেখক


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫