
প্রতীকী ছবি
পৃথিবীর অনেক দেশে গণিকাবৃত্তি অপরাধ নয়। বেলজিয়ামে গণিকাবৃত্তিতে যুক্তদের সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পেনশন দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এই পেশায় যুক্ত রয়েছে প্রায় কয়েক লাখ মানুষ। তবে আমাদের দেশের আইনে এই পেশাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর হিসেবে গণিকাবৃত্তি নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশে বলবৎ ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি, অনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৩৩, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-সহ সব আইনে গণিকাবৃত্তির উদ্দেশ্যে কাউকে বিক্রি, ক্রয়, ভাড়া নেওয়া এবং ভাড়া দেওয়া গুরুতর অপরাধ। সেই সঙ্গে কাউকে গণিকাবৃত্তির কাজে উৎসাহিত করা, কোনো গণিকাবৃত্তির আয়ের ওপর জীবিকা নির্বাহ করা, নারী ব্যবসা পরিচালনার জন্য যৌনপল্লি স্থাপন অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের গণিকাবৃত্তির কাজে বিক্রি, ক্রয়, ভাড়া নেওয়া, ভাড়া দেওয়া দণ্ডবিধি ৩৭২ এবং ৩৭৩ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং যার সাজা হিসেবে অপরাধীকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যায়। গণিকাবৃত্তির কাজে উৎসাহিত করা, কোনো গণিকাবৃত্তির আয়ের ওপর জীবিকা নির্বাহ করা, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে গণিকাবৃত্তি হিসেবে কাজে লাগানো ইত্যাদির শাস্তির কথা বলা আছে অনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৩৩-এর বিভিন্ন ধারায়। যেখানে এই কাজের জন্য তিন বছর মেয়াদে কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।
২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে যৌনপল্লি স্থাপনের শাস্তিকে কঠোর করা হয়। যেখানে ১২ (১) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি পতিতালয় স্থাপন বা পরিচালনা করলে বা পরিচালনা করতে সহায়তা করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-এ পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে কাউকে প্ররোচিত করা বা শোষণ করাকে উপদ্রব হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোনো আইনেই পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জনকারী গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত বা তার পেশাকে অপরাধ বলা হয়নি এবং গণিকাবৃত্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন লিঙ্গ নিরপেক্ষ আচরণ করেনি, কারণ পুরুষ গণিকাবৃত্তি পেশার বিষয়ে কোনো বিধান আইনে উল্লেখ নেই।
বাংলাদেশের আইন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গণিকাবৃত্তির কর্মক্ষেত্র অবৈধ, কিন্তু পেশা হিসেবে গণিকাবৃত্তি অবৈধ না। সংবিধানসহ বলবৎ আইনগুলোতে গণিকাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ও নিরোধের কথা বলা হলেও পেশাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি।
এই নিয়ে ১৯৯৯ সালে টানবাজার-নিমতলী যৌনপল্লি উচ্ছেদের পর ১০০ জন যৌনকর্মী ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’র সহায়তায় হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। সেই পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালে রায়ে বিচারক মতামত দেন যে, প্রচলিত আইনে যা থাক যৌনপল্লি পরিচালনা ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের গণিকাবৃত্তি কর্মে নিয়োগ নিষিদ্ধ হলেও পেশাদার গণিকাবৃত্তি কোনো আইনেই নিষিদ্ধ নয়। নারী যৌনকর্মীর বয়স ১৮ বছরের ওপরে হলে এবং যৌন ব্যবসাই তার একমাত্র আয়ের উৎস প্রমাণ করতে পারলে তিনি বৈধভাবে এই ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। রায়ে আরো বলা হয়, জীবন ও জীবিকার স্বাধীনতা ও আইনের সুরক্ষা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার সব নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য; গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যারা যুক্ত তারা এই আইনের বাইরে নন। তাই বাংলাদেশের আইনি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রতীয়মান হয়, গণিকাবৃত্তি জীবিকা হিসেবে বৈধ এবং আইন স্বীকৃত পেশা। এই পেশাকে আইন দ্বারা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়েছে।
তবে মুসলিম আইনে গণিকাবৃত্তি একটি গুরুতর অপরাধ। ইসলামে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে হারাম বা অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসলামী শরিয়া আইনে গণিকাবৃত্তি জিনা (ব্যভিচার) একটি গুরুতর অপরাধ; যার জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারিত আছে।