ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে শীতলতা ভেঙে উষ্ণতার ইঙ্গিত

তাসীন মল্লিক
প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫২

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক।
গত বছর সংগঠিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। ১৫ বছর পর সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচের ঢাকা সফর স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে যে, দুই দেশই এবার সম্পর্কের শীতলতা ভেঙে আলোচনার টেবিলে ফিরতে চাইছে। বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাসহ একাধিক বিষয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও একাত্তরের অমীমাংসিত প্রশ্নটি আবারও হাজির হয়েছে প্রেক্ষাপটে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এ ইঙ্গিতকে দেখছেন ভিন্ন ভিন্ন চোখে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কে দাঁড়িয়ে থাকা আগের সরকারের নীতির বিপরীতে এখন এক নতুন ভারসাম্যের খোঁজ চলছে। বাণিজ্য ও আন্তঃসম্পর্কের বরফ গলতে আরো পথ পাড়ি দিতে হবে বলে মত তাদের।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উদ্ভব হয়েছে বড় আকারে সম্পর্ক উন্নয়নের। যেহেতু এটি রাজনৈতিক স্তরেই, সেহেতু রাজনৈতিক কতগুলো বিষয় এখনো রয়ে গেছে।’
এদিকে চলতি মাসেই প্রায় দেড় দশক পর ঢাকা ও ইসলামাদের মধ্যে ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে পাকিস্তান। ঢাকায় ওই কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে দুই দেশের মধ্যে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পরই দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সুস্পষ্টভাবে জানা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শহীদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের বিষয়টি নির্ভর করছে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার ওপর। তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।’
অমীমাংসিত প্রশ্নের সমাধান চায় বাংলাদেশ
সম্প্রতি পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও নৃশংসতার জন্য ইসলামাবাদের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে ঢাকা। এ দাবি নতুন নয়, কিন্তু এবার বাংলাদেশ তার অবস্থান আরো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক পরিসরে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের সময়কালের অপরাধ ও সম্পদ বণ্টনবিষয়ক বিষয়গুলো এখনো নিষ্পত্তিহীন রয়ে গেছে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে বাংলাদেশের সম্পদের অংশ হিসেবে পাকিস্তানের কাছে ৪.৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে ঢাকা। অর্থাৎ স্বাধীনতা-পূর্ব আর্থিক পাওনার হিসাব এবার আনুষ্ঠানিকভাবে টেবিলে তুলেছে বাংলাদেশ। তবে ইসলামাবাদের দিক থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট অবস্থান দেখা যায়নি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা প্রতিনিধি দলের কেউই ‘ক্ষমা’, ‘ক্ষতিপূরণ’ কিংবা ইতিহাস নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। বরং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ও ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর কথাই উঠে এসেছে তাদের পক্ষ থেকে।
ফলে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই ‘অমীমাংসিত ঐতিহাসিক’ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কৌশলগত সম্পর্ক যতই উষ্ণ হোক না কেন, অতীতকে পাশ কাটিয়ে টেকসই আস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট ভালো একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন পাকিস্তান কেন একাত্তর থেকে বেরিয়ে আসছে না, আমাদের বোধগম্য না। অথচ ফ্রান্স ও জাপানের মতো দেশগুলো অন্য দেশের ওপর ঘটানো অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছে।’
তবে বাংলাদেশের ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণ চাওয়ার বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে অধ্যাপক শহীদুজ্জামান বলেন, ‘এর আগেও পাকিস্তান তিনবার ক্ষমা চেয়েছে। ৫০ বছর পর এখনো এটি আবার তুলে আনা ভারতীয় চালাকি, যেন
পাকিস্তান-বাংলাদেশের সম্পর্কটা আটকে থাকে। আমার বোধগম্য না কিসের ভিত্তিতে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি উঠেছে, বাংলাদেশের জনমত কি এটি চায়।’
ঢাকা-ইসলামাবাদ বৈঠকে কানেক্টিভিটি ও বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার বার্তা
ঢাকা সফররত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রা নেওয়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট করে তুলেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আলোচনায় উঠে এসেছে কেবল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই নয়, বরং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা খুঁজে বের করার বিষয়টিও।
উভয় দেশই বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা ও আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি- এই চারটি খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, পাকিস্তানের
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা হতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশও মৎস্য ও সামুদ্রিক প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে।
বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে কানেক্টিভিটি। করাচি-চট্টগ্রাম সরাসরি নৌপথ চালুর উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে আবারও সরাসরি আকাশপথ চালু করার ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। ২০১৮ সালের পর বন্ধ থাকা বিমান সংযোগ চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। উভয় পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে ভ্রমণ ও ভিসা ব্যবস্থাকে সহজ করার সাম্প্রতিক অগ্রগতির ব্যাপারে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার বিষয়টি উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করবে জানিয়ে ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, ‘যতক্ষণ না ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভ দেখছে ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ কোনো দেশের ব্যবসায়ীই লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন না।’
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমানে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সংখ্যা দুই দেশের সম্ভাবনা ও ভূ-অবস্থান বিবেচনায় নিতান্তই সামান্য। তবে বাস্তবতার ছকে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার এক সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য বিধিনিষেধ ও নীতিগত জটিলতা সম্পূর্ণভাবে দূর করা যায়, তাহলে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এই বাণিজ্য তিন বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
নতুন পথচলায় বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার বিষয়টি পাকিস্তানের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে মন্তব্য করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘গত ৫০ বছরে তুলনামূলকভাবে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো যে, পাকিস্তান বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য তার বাজার খুলে দিবে কিনা? আমাদের ব্যবসায়ীরা সেখানে বিনিয়োগ করতে পারবে কিনা? কারণ আমাদের ব্যবসায়ীরা চাইবে না আরেকটি দুর্বল বিনিয়োগে নিজেদের বাজার সংকুচিত হয়ে যাক।’ লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দেশকাল নিউজ