Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

মধুর খোঁজে সুন্দরবনের গহিনে

Icon

শামছুল হক রিপন

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১১:৫৩

মধুর খোঁজে সুন্দরবনের গহিনে

সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করছে মৌয়ালরা। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

সুন্দরবনের মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ শুরু করেছেন। এবারের মৌসুম শুরু হয়েছে ৭ এপ্রিল। চলবে ৩১ মে পর্যন্ত। ফরেস্ট অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে শত শত মৌয়াল নেমে পড়েছেন মধু সংগ্রহের অভিযানে। মৌয়ালদের সঙ্গে সুন্দরবনের গহিনে গিয়েছিলাম মধু সংগ্রহ দেখতে। তবে সেই ভ্রমণের বর্ণনা দেওয়ার আগে কিছু তথ্য দিয়ে রাখছি।

সুন্দরবনে বংশপরম্পরায় মধু সংগ্রহ করেন মৌয়ালরা। মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ও গরান ফুলের মধু আসে। এরপর আসে কেওড়া ফুলের মধু। প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন। দেশে যত ধরনের মধু পাওয়া যায় তার মধ্যে সুন্দরবনের মধুই সেরা। বন বিভাগের আশা, এ বছর মধু সংগ্রহের পরিমাণ বাড়বে সুন্দরবনে।

১৮৮৬ সালে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য পাস দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। গত ৮ এপ্রিল মৌয়ালদের ছয়জনের একটি দলের সঙ্গে ঢুকি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুন্দরবনে। আমরা আলাদা একটা নৌকা নেই। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সুন্দরবনের খালের ভেতর দিয়ে মৌয়ালরা নৌকা চালানো শুরু করেন। ঢুকে যেতে থাকে গভীর জঙ্গলে। তাদের অনুসরণ করে আমাদের নৌকাও।

দলে পর্যটক ও আলোকচিত্রী মিলিয়ে আমরা ছয়জন। দুই দিন ছিলাম। আমরা থাকা অবস্থায় একটা মৌচাক ভাঙা হয়। বন বিভাগ দুই মাসের কাছাকাছি সময়ের জন্য মৌয়ালদের বনে মধু সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে থাকে। তবে একেকবারে ১৫ দিনের জন্য অনুমতি পান তারা। 


মৌমাছির হুল ফুটানো থেকে বাঁচাতে গামছা দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নিয়েছেন মৌয়ালদের কেউ, কেউ আবার পড়েছেন ক্যাপ। সবাই খুঁজে ফেরেন মধু ভরা মৌচাক। আমাদের সতর্কতা আরো বেশি। আমি মৌমাছির হুল থেকে বাঁচতে আগাগোড়া নিজেকে ঢেকে ফেলেছি। মাথা-মুখ ঢেকে দেওয়া ক্যাপ, হাতে গ্লাভস ও ফুল হাতার শার্ট ও গামবুট পরেছি। 

শেষ পর্যন্ত মধুর চাকের খোঁজ মিলল। এখানে বলে রাখা ভালো, চাক ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন দলনেতা, মৌয়ালরা যাকে বলেন বহরদার। বহরদার অভিজ্ঞ মৌয়াল। তিনি আগে পরখ করে নেন চাকটি আগের কাটা কিনা। কারণ একবার কাটা চাক দ্বিতীয়বার কাটা হলে সে চাকের মৌমাছিরা খুব বেশি হিংস্র হয়। সবার হাতে থাকে দা ও ধামা।

বহরদারের অনুমতি মিললে গাছে চড়ে মৌচাকে আগুনের ধোঁয়া দিলেন একজন। অন্যরা দা দিয়ে কাটা শুরু করেন চাক। নিচে বেতের তৈরি ধামা পেতে কাটা চাক ধরলেন আরেকজন। এভাবেই জঙ্গলে জঙ্গলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন মৌয়ালরা।

তবে চাক ভাঙার সময় আমাদের সঙ্গী মৌয়ালদের কেউ কেউ কামড় খেলেন। সঙ্গের এক মৌয়াল তো ৩০টির মতো কামড় খেয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করা হয়েছিল চার হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে তিন হাজার আট কুইন্টাল হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরো কমে হয় দুই হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে তিন হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। 

সংগ্রহ শেষে মধু নিয়ে নৌকায় ফেরেন মৌয়ালরা। মাটির মটকিতে বা বালতিতে রাখেন সংগ্রহ করা চাকসহ মধু। প্রথম কাটা চাকের মধুর কিছু অংশ নৌকার মাথায় মেখে দেন তারা। 

যে দলের সঙ্গে বনে এসেছি তাদের একজন মৌয়াল সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর মধু আহরণের জন্য অনুমতি পেয়েছি। সাতজনের বহর নিয়ে ১৫ দিনের জন্য বাজার-সদাই নিয়ে রওনা হয়েছি। কিন্তু এ বছর ডাকাতদলের উৎপাত অনেক বেশি। তার ওপর আবার বৃষ্টি কম। বৃষ্টি না হলে ফুল ঝরে যায়, মধু জমে না। তাই চাকে কেমন মধু হবে সেটা নিয়েও চিন্তিত। 

স্থানীয় জেলে-বাওয়ালি ও মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সুন্দরবনে ছোট-বড় মিলিয়ে এখনো কয়েকটি বনদস্যু দল থাকায় তারা মধু আহরণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বনদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে বনে ঢুকলে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যার কারণে তারা আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে সুন্দরবনে যেতে পারছেন না।


কয়েকজন মৌয়াল জানান, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ফুলের মধু আসে। এর ২০ থেকে ২৫ দিন পর আসে গরান ফুলের মধু। শেষে আসে কেওড়া ও ছইলা ফুলের মধু। এই তিন প্রজাতির মধুর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ও দামি হচ্ছে খলিশার মধু। কেজিপ্রতি মধু এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা বিক্রি হয়। আর মৌসুমের প্রথম ফুলের মধু, দেখতে সাদা, গাঢ় ও অনেক বেশি মিষ্টি। 

‘এলাকায় তেমন কোনো কাজকর্ম না থাকায় মহাজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে মধু কাটতে এসেছি। মধু না পেলে চালানে মার খাব, ঋণের বোঝা টানতে হবে। আবার সুন্দরবনে কয়েকটি ডাকাতদল আছে, তাদের কাছে ধরা পড়লে গুনতে হবে টাকা।

সুন্দরবনে বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান জানান, সাতক্ষীরা রেঞ্জে এবারের আহরণের টার্গেট ধরা হয়েছে এক হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু ও ৪০০ কুইন্টাল মোম।

চাইলে মৌয়ালদের সঙ্গে আপনিও যেতে পারেন মধু সংগ্রহ দেখতে। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে যেতে হবে সাতক্ষীরা মুন্সীগঞ্জ। সেখান থেকে বাসে শ্যামনগর। ফরেস্ট অফিসে রাজস্ব দিয়ে বনরক্ষী নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করবেন। বনে যাওয়ার জন্য নৌকা ভাড়া পাওয়া যাবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫