Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

অন্ধকারে আশার আলো

প্লাজমা থেরাপি ও দেশে তৈরি ভেন্টিলেটর

Icon

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২০, ০৯:২৮

প্লাজমা থেরাপি ও দেশে তৈরি ভেন্টিলেটর

করোনাভাইরাস সংক্রমণে চিকিৎসক ও মানুষের মধ্যে প্রথমদিকে প্রচণ্ড হতাশা ছিল। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি না হলেও কিছু আশার আলো ফুটে উঠেছে। 

করোনাভাইরাস নিজেকে এত বেশি পরিবর্তন করে নিয়েছে যে, গবেষকরা এর ওষুধ আবিষ্কার করতে পারছেন না। তবু নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে, টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। অন্যান্য রোগের জন্য তৈরি ওষুধ নিয়েও পরীক্ষা হচ্ছে, যেমন- রেমডেসিভির, ইভারমেক্টিন ইত্যাদি। 

প্রচলিত চিকিৎসা দেয়ার পর বেশিরভাগ সুস্থ হয়ে গেলেও কিছু রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় চলে যান। তাদের জন্য প্রয়োজন হয় আইসিইউ বেড এবং আরো বেশি মারাত্মক রোগীদের কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য প্রয়োজন হয় ‘ভেন্টিলেটর’ নামক একটি যন্ত্রের। 

বিশ্বের কোথাও ওষুধ নেই বলে বাংলাদেশেও ওষুধ নেই। ব্যবস্থাপনা চিকিৎসা (দেহে যখন যে সমস্যা তৈরি হয় তা সমাধানের চেষ্টা) দেয়ার কারণে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এর মধ্যেই আশার আলো দেখাচ্ছে প্লাজমা কনভালসেন্ট বা প্লাজমা থেরাপি চিকিৎসা।

ভেন্টিলেটরও দেশে তৈরির চেষ্টা চলছে। দেশে তৈরি হলে হয়তো আর বিদেশ থেকে আনতে হবে না এবং খুবই অল্প দামে পাওয়া যাবে বলে সরকারি হাসপাতাল তো বটেই, বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ সহজ হবে। ফলে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবেন অনেক আক্রান্ত ব্যক্তি। 

  • করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে গেলে তার রক্তে অ্যান্টিবডি বা করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। রক্তের জলীয় অংশের মধ্যে এই অ্যান্টিবডিগুলো থাকে বলে রক্ত থেকে লাল অংশ সরিয়ে শুধু ‘জলীয় অংশ’ নতুন আক্রান্ত রোগীকে দেওয়া হয়। জলীয় অংশে থাকা অ্যান্টিবডি পেয়ে চার থেকে পাঁচ দিন পর কোভিড-১৯ রোগী সুস্থ হয়ে যান বলে দাবি চিকিৎসকদের।

করোনাভাইরাস যুবা বয়সীদের চেয়ে প্রবীণ ও বৃদ্ধদের বেশি ভুগিয়ে থাকে। বৃদ্ধদের মধ্যে মৃত্যুর হারও বেশি; কিন্তু বাংলাদেশের এক অশীতিপর ব্যক্তি আশার আলোর দেখিয়ে যাচ্ছেন। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ও প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গত ২৫ মে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিজেই সংবাদ মাধ্যমকে জানান। গত কয়েক বছর থেকে তার দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে গেলে সপ্তাহে তিন দিন তাকে ডায়ালাইসিস করে চলতে হয়। এর মধ্যেই তিনি করোনা পজিটিভ হলেও, ভেঙে না পড়ে সাহসের সাথে রোগটি মোকাবেলা করছেন এবং তিনি হয়ে উঠছেন অন্যান্য কভিড-১৯ রোগীর প্রেরণার উৎস। 

তিনি প্রথমে নিজের বাসায় আইসোলেশনে থাকলেও পরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নিয়েছেন প্লাজমা থেরাপি। গত ৩১ মে তার সামান্য শ্বাসকষ্ট দেখা দিলেও, ১ জুন বিকেলের দিকে তিনি অধিকতর সুস্থতা বোধ করেন।

প্লাজমা থেরাপি কী? 

আগে থেকে সুস্থ হওয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর রক্তের জলীয় অংশ সংগ্রহ করে তা নতুন আক্রান্তের দেহে মেশিনের মাধ্যমে দেয়ার পদ্ধতিই ‘প্লাজমা থেরাপি’ বা ‘প্লাজমা কনভালসেন্ট’। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে গেলে তার রক্তে অ্যান্টিবডি বা করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। রক্তের জলীয় অংশের মধ্যে এই অ্যান্টিবডিগুলো থাকে বলে রক্ত থেকে লাল অংশ সরিয়ে শুধু ‘জলীয় অংশ’ নতুন আক্রান্ত রোগীকে দেয়া হয়। জলীয় অংশে থাকা অ্যান্টিবডি পেয়ে চার থেকে পাঁচ দিন পর কভিড-১৯ রোগী সুস্থ হয়ে যান বলে দাবি চিকিৎসকদের। 

বাংলাদেশে প্রথমে একটি তারকা হাসপাতাল শুরু করলেও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগ এটি নিয়ে একটি গবেষণা শুরু করে। 

তবে কভিড-১৯ রোগীদের প্রথম প্লাজমা থেরাপি দেওয়া শুরু হয় চীনের উহানে। সেখানে এ থেরাপিতে কিছুসংখ্যক রোগী সুস্থ হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই চিকিৎসা শুরু করে। 

প্লাজমা থেরাপি কাজ করায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঘোষণা দেন যে, তিনি তার হাসপাতালে ‘প্লাজমা ব্যাংক’ তৈরি করবেন, যাতে সহজেই আক্রান্তরা এখান থেকে প্লাজমা নিতে পারেন। মূলত প্লাজমা থেরাপি প্রথম প্রয়োগ হয় আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়। 

দেশীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে ভেন্টিলেটর

‘ফুসফুসের বায়ু থলিগুলোতে জলীয় পদার্থ জমে থাকায় শ্বসনের মাধ্যমে নেয়া অক্সিজেন অক্সিহিমোগ্লোবিনে রূপান্তরে বাধাপ্রাপ্ত হয় (এই থলিগুলোতেই রক্তের অক্সিজেন থাকে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হয়)। থলিগুলো তরল দিয়ে ভর্তি হয়ে যায় বলেই কভিড-১৯ রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ও এটাকে নিউমোনিয়া বলা হয়ে থাকে। সে অবস্থায় একজন অসুস্থ ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালাতে পারে না। 

এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে যে, প্রায় ছয় শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ অতি জটিল পর্যায়ে চলে যায়। রোগের এই ধাপে শরীর স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারে না ও মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হয়। এই ধাপে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে ও সারা শরীরেই বিভিন্ন রকম প্রদাহ তৈরি করে। তখন রোগীকে কৃত্রিমভাবে মেশিনের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। ওই মেশিনটির নামই ‘ভেন্টিলেটর’। 

বাংলাদেশে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা এখনো দুইশ’র ঘর অতিক্রম করেনি। কারণ ভেন্টিলেটর মেশিনটি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় ও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। করোনাভাইরাসের এ সময়ে ভেন্টিলেটরের খুব প্রয়োজন দেখা দেয়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে ভেন্টিলেটর তৈরিতে। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও কেউ কেউ ভেন্টিলেটর তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন। ভেন্টিলেটর তৈরিতে কাজ করছে কয়েকটি নামি প্রতিষ্ঠানও।

এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি’ (বিএমটিএফ) অন্যতম। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির কনসেপ্টে, টাইগার আইটির সহযোগিতায় এই ভেন্টিলেটর তৈরি করছে। এখানে সপ্তাহে এক হাজার ভেন্টিলেটর তৈরি করা যাবে বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর গণসংযোগ বিভাগ ‘আইএসপিআর’। 

মেশিন টুলসের উদ্ভাবিত ভেন্টিলেটর এর মধ্যেই ঢাকার সিএমএইচে কয়েকজন রোগীর ওপর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে এবং পরীক্ষায় সাফল্যও এসেছে। এখন মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি বাণিজ্যিকভাবে ভেন্টিলেটরের উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ভেন্টিলেটর তৈরির তত্ত্বাবধায়ন করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।  

এছাড়া দেশীয় কোম্পানি ওয়াল্টন শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর তৈরি করছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি মেডট্রনিকের সহায়তায় ভেন্টিলেটর তৈরি করার কাজ করছে। ‘মেডট্রনিক’ কোম্পানি আগে থেকেই ভেন্টিলেটর তৈরি করে থাকে ও বিশ্বব্যাপী সরবরাহ করে। করোনাভাইরাস সংকটের এ সময়ে মেডট্রনিক কোম্পানি তাদের তৈরি ভেন্টিলেটরের স্বত্ব উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং একইসাথে এর ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশনও দিচ্ছে সবাইকে। বাংলাদেশে টেলিভিশন ও ফ্রিজার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়াল্টনকে সহযোগিতা করবে তারা। 

উল্লেখ্য, মেডট্রনিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) একজন বাংলাদেশি। তার নাম ওমর ইশরাক। তিনি কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ নির্মাতা কোম্পানি ইনটেলেরও চেয়ারম্যান। ওয়াল্টনকে ভেন্টিলেটর তৈরিতে সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন ওমর। 

এদিকে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) এআইএমএস ল্যাব ও এএনটিটি রোবোটিকস লিমিটেড সমন্বিতভাবে সপ্তাহে ২০টি ইমারজেন্সি ভেন্টিলেটর বানাতে পারবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাদের ডিজাইন করা ভেন্টিলেটরটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য তৈরি হচ্ছে। তাদের ভেন্টিলেটর তৈরিতে আইসিইউর বিশেষজ্ঞ হিসেবে কয়েকজন চিকিৎসকও সাহায্য করছেন।

এআইএমএস ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. খোন্দকার এ মামুন বলেন, ‘দেশীয় প্রযুক্তিতে হচ্ছে বলে তাদের নির্মিত ভেন্টিলেটরের খরচ পড়বে মাত্র ৪০ হাজার টাকা।’ এএনটিটি রোবোটিকস ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগানে ২০১৭ সাল থেকে রোবোটিকস নিয়ে রিসার্চ করে নানা কিছু তৈরি করছে। তারা দেশে ও বিদেশে তাদের তৈরি যন্ত্রপাতিও বিক্রি করে থাকে।

এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবেও কেউ কেউ ভেন্টিলেটর তৈরির চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষার্থীর নামও আছে। তার নাম সানি যুবায়ের। তার উদ্ভাবিত একেকটি ভেন্টিলেটরের খরচ পড়বে মাত্র ৭ হাজার টাকা। নিজের তৈরি সাশ্রয়ী মূল্যের ভেন্টিলেটর সম্পর্কে সানি যুবায়ের বলেন, ‘আমরা বাইরের দেশ থেকে যে ভেন্টিলেটর আনি এগুলোর দাম অনেক বেশি। ওই ভেন্টিলেটর বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। ভেন্টিলেটরের সাহায্যে ফুসফুসে অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়া ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে আনা হয়। আমার তৈরি ভেন্টিলেটর এই কাজটা পুরোপুরি করতে সক্ষম।’ 

যুবায়ের দাবি করেন, তার এই যন্ত্রটি সহজলভ্য ও এটি ব্যবহারে অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। সানি আরো বলেন, ‘এটি আরো উন্নত করা হবে, যাতে সহজেই এটি কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫