গার্ডিয়ানে প্রধানমন্ত্রীর নিবন্ধ
দুর্যোগ মোকাবিলায় অন্যদের শিক্ষা দিতে পারি আমরা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২০, ১৫:৪৫

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুইটি আঘাত- সুপার ঘূর্ণিঝড় আমফান ও করোনাভাইরাস মহামারি সফলভাবে মোকাবিলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ অন্যদের শিক্ষা দিতে পারে।
মর্যাদাপূর্ণ ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে এই বিষয়ে তার নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি নিবন্ধে বলেছেন, বাংলাদেশ সুপার-সাইক্লোনিআমপান ও কভিড -১৯ এর মতো দুইটি বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আমরা অন্যদেরকে অনুরূপ বিপদ মোকাবিলায় পাঠ দিতে পারি।
‘ঘূর্ণিঝড় ও করোনাভাইরাস মোকাবিলা: আমরা কীভাবে মহামারি চলাকালীন লাখ লাখ লোককে সরিয়ে নিয়েছি’ শীর্ষক নিবন্ধটি গতকাল বুধবার গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
অভিযোজন সংক্রান্ত গ্লোবাল সেন্টারের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার প্যাট্রিক ভেরকুইজেনের সাথে যৌথ নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, কভিড-১৯ মহামারিতে ব্যাপক জনসাধারণের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে সুপার সাইক্লোন আমফান আঘাত হানার আগেই কত দ্রুত ও সাফল্যের সাথে বাংলাদেশ দুই লক্ষাধিক লোককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছিল।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আমফান ভারত মহাসাগরের উপর তৈরি হতে শুরু করার ফলে নষ্ট করার মতো কোনো সময় ছিল না। বাংলাদেশে সামাজিক দূরত্বের কথা বিবেচনা করে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নির্মিত হয়নি। তাই দেশ একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে- কীভাবে ২.৪ মিলিয়ন মানুষকে কভিড -১৯ এর মতো আরো বড় বিপদে না ফেলে ঝড়ের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সরিয়ে নেয়া যায়।
সর্বোত্তম সময়ে বিপুল সংখ্যক লোককে সরিয়ে নেয়া সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয়। লোকজন নিরাপত্তা ছাড়া তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে নারাজ। এবার চ্যালেঞ্জ ছিল আরো বেশি জটিল। কারণ লোকজন করোনাভাইরাসে আকান্ত হওয়ার ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে ভয় পাচ্ছিল। প্রথম সাড়াদানকারীদেরকে নিশ্চিত করতে হচ্ছিল যে, আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়ার ফলে সংক্রমণ ঘটবে না।
বাংলাদেশ অল্প সময়েই, সামাজিক দূরত্বের কিছুটা ব্যবস্থার সাথে বিদ্যমান ৪ হাজার ১৭১টি আশ্রয়কেন্দ্রের অতিরিক্ত প্রায় ১০ হাজার ৫শ’ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে।
উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে ৭০ হাজারের বেশি ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি’ স্বেচ্ছাসেবীরা সক্রিয় ছিল। এ সময় মাস্ক, পানি, সাবান ও স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। রফতানি আদেশ বাতিল হওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও পোশাক শিল্প ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে সম্পৃক্ত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক থেকে দেয়া পূর্বাভসের প্রেক্ষিতে মহামারির তীব্রতার মুহূর্তে এসে আমফানের মতো একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় প্রশাসন মানবজাতির সামনে উপস্থিত জলবায়ুর ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে মনোনিবেশ করে।
সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, আটলান্টিক ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে পানির অস্বাভাবিক গরম তাপমাত্রার কারণে এই বছরের হারিকেন মওসুম রেকর্ড অতিক্রম করবে। এছাড়া কভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে মানুষকে সুরক্ষিত রাখার কাজটি অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠবে।’
শেখ হাসিনা যৌথ নিবন্ধে আরো লিখেছেন, ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর নেটওয়ার্কসহ বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতির ফলে আমফানের আঘাতে ভারত ও বাংলাদেশে ১শ’রও কম মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যেকোনো মৃত্যু দুঃখজনক। তবুও দেশের আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা ও সুপরিকল্পিতভাবে লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার অনুশীলন বিগত বছরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ জীবন রক্ষা করেছে।
ক্লাইমেট ভালনেরাবল ফোরামের সভাপতি শেখ হাসিনা নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাৎক্ষণিক প্রভাব মোকাবিলা করা যথেষ্ট নয়; জনগোষ্ঠীকে পরবর্তী ঝড়ের জন্য আরো ভালভাবে প্রস্তুত রাখা দরকার।
নিবন্ধে আরো বলা হয়, ‘অবকাঠামো পুননির্মাণ ও জীবিকা নির্বাহ করা অবশ্য অন্য বিষয়। বাংলাদেশ এর আগে অনেকবার ঘূর্ণিঝড়ের পর পুনর্গঠন করেছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশের ভূমির দুই-তৃতীয়াংশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটারেরও কম উচ্চতায় অবস্থিত। এখানে পুননির্মাণ একটি বড় কঠিন কাজ।
জলবায়ু সংকট এ কাজকে আরো কঠিন করে তুলেছে। ঘূর্ণিঝড়গুলো দিন দিন আরো তীব্র ও ঘন ঘন তৈরি হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে কূপ ও কৃষি জমি বিষাক্ত হয়ে ওঠছে। মহামারি ও গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটের অর্থ হচ্ছে সরকারকে এখন একই সাথে স্বাস্থ্য, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
ঘূর্ণিঝড় আমফান যে ক্ষতি করেছে তার পরিমাণ আনুমানিক ১৩ বিলিয়ন ডলার (১০.৪ মিলিয়ন পাউন্ড)। বাংলাদেশে এই ঝড়ে ৪১৫ কিলোমিটার রাস্তা, ২০০ টি সেতু, কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, বিস্তীর্ণ কৃষিজমি ও মৎস্য সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। জলোচ্ছ্বাস রোধের জন্য তৈরি করা ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’
যেকোনো দুর্যোগের জন্য পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, এই ঝড় বিপর্যয়কর হয়েছে। তবে পরিকল্পনা থাকলে দেশগুলো বিপর্যয় মোকাবিলায় আরো ভালভাবে প্রস্তুত থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাৎক্ষণিক প্রভাব মোকাবিলা করার পক্ষে এই প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়; পরবর্তী ঝড়ের জন্য লোকজনকে আরো ভালভাবে প্রস্তুত রাখ দরকার।
প্রধানমন্ত্রী তার নিবন্ধে আরো বলেছেন, বাংলাদেশ ২০১৪ সালে ক্লাইমেট ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন করেছে। জলবায়ু সহিষ্ণুতা তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ। এই কাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী ব্যয়ের জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে এবং কৃষি, গ্রহায়ন ও জ্বালানিসহ ২০ টি মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু সম্পর্কিত ব্যয় পর্যালোচনা করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘৩০ মিলিয়ন লোকের বাসস্থান এই বদ্বীপ অঞ্চলের জন্য ২০১৮ সালে আট দশকের জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ডেল্টা প্ল্যান- ২১০০ অনুযায়ী জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় আরো উচ্চ বাঁধ তৈরির মতো অবকাঠামো শক্তিশালীকরণের উপর জোর দেয়া হয়েছে।
আমফানের পরে স্কুল, হাসপাতাল ও ঘরগুলো আরো মজবুত করে পুনরায় তৈরি করতে হবে, যাতে এগুলো উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ করতে পারে ও আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে দ্বিগুণ লোক ধারণ করতে পারে। বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ সরকারি অর্থায়নে একটি বড় ধরণের চাপ সৃষ্টি করেছে। তবে আমরা বিশ্বাস করি, দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক কাঠামো ও জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা এসব দেশকে দুর্যোগ মোকাবিলায় আরো ভাল সহায়তা দেবে। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও জলবায়ু সহিষ্ণুতা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত।
এই কারণেই ডেল্টা পরিকল্পনায় জমি ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পসমূহ এবং জনগণকে স্বাস্থ্যবান ও আরো স্বচ্ছল করার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি ধ্বংসাত্মক ঝড়ের পরে রোগ প্রতিরোধ করতে দূষিত পানি ফিল্টার করার জন্য সৌরচালিত হোম কিট ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই বছর কেবল বাংলাদেশই স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে না। তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সারা বিশ্বের সাফল্য থেকে শিখতে ও একে অপরকে সহায়তা করতে পারি। একসাথে আমরা আরো শক্তিশালী ও আরো সহিষ্ণু হয়ে ওঠতে পারবো। -বাসস