
ইউরোপের লোভ দেখিয়ে গ্রামের তরুণদের মগজ ধোলাই করে দেশছাড়া করছে দালালচক্র। মাসে লাখ টাকা উপার্জনের লোভ দেখিয়ে চার থেকে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে মরুভূমি, সাগর পেরিয়ে মরণযাত্রায় ঠেলে দিচ্ছে এই তরুণদের।
পথেই মারা পড়ছেন অনেকেই। কেউ যাত্রাপথে কিংবা ইউরোপে প্রবেশের সময় ধরা পড়ছেন। শেষ পর্যন্ত যে কয়েকজন প্রাণ নিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করতে পারেন, তাদের ‘সাফল্য’ প্রচার করে আরো বহু তরুণকে এই পথে টেনে আনছে দালালচক্র।
গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহতে দালালের গুলিতে নিহত হন ২৬ বাংলাদেশি। আহত হন আরো ১১ জন।
হতাহতদের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন। প্রত্যেকের উদ্দেশ্য, লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালি যাওয়া। শুধু এই তরুণরা নয়, বছরে কয়েক হাজার তরুণ ইউরোপের মোহে দেশ ছাড়ছেন। জমিজমা বিক্রি করে দালালের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন।
জনশক্তি খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও লিবিয়ায় পাড়ি দেয়া তরুণদের সূত্রে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার দুটি পথের কথা জানা গেছে।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন বিশেষ সুপারিনটেনডেন্ট সাম্প্রতিক দেশকালকে জানিয়েছেন, প্রথম পথ হলো- আকাশপথে টুরিস্ট ভিসায় ঢাকা থেকে দুবাই। সেখান থেকে সুদান বা মিসর হয়ে সীমান্ত দিয়ে লিবিয়ায় প্রবেশ করানো হয়। তারপর বেনগাজি হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ে নেয়া হয়। ইঞ্জিন নৌকায় তুলে সাগর পেরিয়ে নেয়া হয় ইতালি। দুই থেকে ছয় মাস পর্যন্ত লাগে এ যাত্রাপথে।
বেশভুষা ও সামাজিক অবস্থান দেখে লিবিয়াগামী অনেককেই ঢাকায় বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে আটকে দেয়া হয়। দুবাইয়ে বেড়াতে যাওয়ার কারণ বলতে না পারলেও আটকে দেয়া হয়। এ কারণে দালালচক্র বেছে নিয়েছে দ্বিতীয় পথ।
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে যাদের পাচার করা হয়, তাদের সড়কপথে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় টুরিস্ট ভিসায়। ভারত যাওয়ার ক্ষেত্রে স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশনে কাউকে আটকানোর নজির নেই। বাংলাদেশিদের ভারতে বেড়াতে যাওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। তাই কেউ ভারতের ভিসা নিয়ে সড়কপথে দেশ ছাড়লে ইমিগ্রেশনের সন্দেহে পড়তে হয় না। দলবেঁধে আদম পাচার করা হলেও, একসাথে সবাইকে পাঠানো হয় না। ছোট ছোট দলে পাঠানো হয়। কলকাতা থেকে নেয়া হয় মুম্বাই। সেখান থেকে দুবাইয়ের টুরিস্ট ভিসা করা হয়। দুবাই থেকে কখনো কখনো সরাসরি লিবিয়ার বেনগাজি নেয়া হয়। তবে দুবাই থেকে কোন পথে যাওয়া হবে, তা নির্ভর করে লিবিয়ার যুদ্ধাবস্থার ওপর।
তিনি আরো বলেন, ২০১২ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশটিতে কোনো কার্যকর সরকার নেই। গৃহযুদ্ধে লিপ্ত কয়েকটি পক্ষ চুক্তির মাধ্যমে একটি ‘জাতীয় সরকার’ গড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একে স্বীকৃতি দিলেও, লিবিয়ার সেনাপ্রধান নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান দাবি করে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অংশে নানা মিলিশিয়া বাহিনী সক্রিয় রয়েছে।
এই বাহিনীগুলো সরাসরি ইউরোপে আদম পাচারে জড়িত। তাদের সহযোগী দালাল রয়েছে বাংলাদেশে, যারা ঢাকা থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এ দালালরাই গ্রাম থেকে তরুণদের ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশছাড়া করে। কলকাতা, মুম্বাই, দুবাই, মিসর, সুদানেও সক্রিয় দালালচক্র। এর বেশিরভাগই বাংলাদেশি। ভূমধ্যসাগরের ওপাড়ে স্পেন, ইতালি ও মাল্টাতেও দালাল রয়েছে, যারা সাগর পারের পর ‘আদমদের’ গ্রহণ করে।
কয়েকটি পরস্পরবিরোধী মিলিশিয়া দালালচক্র রয়েছে লিবিয়ায়। যারা আরেক দল মিলিশিয়ার আনা ‘আদম দল’কে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে। মুক্তিপণের জন্য এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা করা হয় না। গত ২৮ মে নিহত ২৬ বাংলাদেশির ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছিল। তারা যে দালাল ধরে লিবিয়ায় গিয়েছিল, প্রতিদ্বন্দ্বী দালালরা তাদের মরুভূমি থেকে অপহরণ করে প্রথম পর্যায়ে জনপ্রতি এক কোটি টাকা দাবি করে। কয়েক দিন আটকে রাখার পর ১২ লাখ টাকা করে দাবি করে।
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের কামাল শেখের ছেলে ওমর শেখ গত বৃহস্পতিবারের ঘটনায় দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তার ভাই জামাল শেখ জানিয়েছেন, স্থানীয় দালাল রবিউলের প্ররোচনায় তার ভাই ওমর, পাশের গ্রামের যুবক সুজন ও সুজনের মামাতো ভাই ফরিদপুরের সালথার কামরুল লিবিয়ায় যেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। দালাল রবিউল জনপ্রতি চার লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে নেয়। লিবিয়ায় যাওয়ার পর আরো আট লাখ টাকা করে দিলে ইতালি পৌঁছে দেয়ার টোপ দেওয়া হয়।
বাড়ি ছাড়ার তিন মাস পর ওমর, সুজন ও কামরুলসহ ৪০ বাংলাদেশি মরুভূমিতে অন্য দালালদের হাতে ধরা পড়ে। জনপ্রতি ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে মাফিয়ারা। টাকার জন্য সিলিংয়ে ঝুলিয়ে পেটানো হতো। আহত অবস্থায় বাড়িতে ফোন করানো হতো। এ সময় রবিউল তাদের সাথে যোগাযোগ করে জানান, ১২ লাখ টাকা দিলে ওমরকে ছেড়ে দেয়া হবে। ইতালি পাঠানো হবে। এর মধ্যে খবর পান ওমর আহত হয়েছেন। সুজন ও কামরুল গুলিতে মারা গেছেন। এরপর থেকে দালাল রবিউল নিখোঁজ।
গত বছরের মে মাসে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা যান ৩৯ বাংলাদেশি। এ ঘটনার পর পুলিশ-র্যাবের হাতে কয়েকজন দালাল ধরা পড়ে। কিছুদিনের জন্য আদম পাচার বন্ধ হয়। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হতেই ফের শুরু হয়েছে তৎপরতা।
প্রায় ছয় বছর ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানি নিষিদ্ধ। তাহলে দেশের সীমানা পেরিয়ে কীভাবে বাংলাদেশিরা দেশটিতে যাচ্ছেন!
প্রবাসী কল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলছেন, ‘যারা লিবিয়ায় গিয়ে নিহত হয়েছেন, তাদের কেউ বৈধভাবে বিদেশ যাননি। তাদের কারও কর্মী হিসেবে যাওয়ার ছাড়পত্র ছিল না।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শামসুল আলম বলেছেন, ‘অবৈধ পথে কেউ বিদেশ গেলে তাকে আটকানো বিএমইটির পক্ষে সম্ভব নয়। বিএমইটি শুধু বিদেশে চাকরি নিয়ে বৈধভাবে দেশ ছাড়া কর্মীদের দেখভাল করে। যারা লিবিয়ায় মারা গেছেন, তাদের কারও নিবন্ধন নেই, নেই স্মার্ট কার্ড।’
তিনি আরো বলেন, ‘দালালের প্রলোভনে বিদেশে যেতে মরিয়া গ্রামের তরুণরা। একজন অবৈধভাবে বিদেশ গেলে তাকে দেখে ১০ জন অনুপ্রাণিত হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অবৈধভাবে বিদেশ যেতে মা-বাবা টাকা তুলে দেন সন্তানের হাতে। যতদিন মা-বাবারা সচেতন না হবেন, ততদিন এ পথ বন্ধ হবে না।’
মানবপাচার নিয়ে কাজ করা স্পেশাল ব্রাঞ্চের সহকারী পুলিশ সুপার (অ্যান্টিহিউম্যান ট্রাফিকিং) শেখ মো. আবু জাহিদ বলেছেন, ‘গ্রামের কিছু তরুণ ইউরোপ বলতে অজ্ঞান। দালাল যখন তাদের বলে ইতালিতে গিয়ে লাখ টাকা কামানোর সুযোগ রয়েছে, তারা আর কিছুই যাচাই-বাছাই করে না। জমিজমা বিক্রি করে, সুদে ঋণ নিয়ে দালালের হাত ধরে রওনা করে। পুলিশ আটকালেও দালালের বিপক্ষে বলে না। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় যায়।’
তিনি আরো জানান, প্রতিটি ঘাটে দালাল রয়েছে। তারা শুধু আদাম পাচার নয়, হুন্ডির সাথেও জড়িত। গ্রামের তরুণরা বিদেশ যেতে যে টাকা দালালকে দেয়, তা বাংলাদেশে লেনদেন হয়। মুক্তিপণ বাবদ দেয়া টাকাও বাংলাদেশেই দেয়া হয় জিম্মিকারীর লোকের কাছে। বিদেশে তো একটি ডলারও পাঠানো হয় না। দালাল দেশ থেকে টাকা নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে তা তার আন্তর্জাতিক সহযোগী বা জিম্মিকারীর কাছে পাঠায়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ২০ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন। এতে ১৯ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন। ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করা চেষ্টা করে, সেই তালিকার শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশ। শুধু চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ৬৯৩ জন বাংলাদেশি সাগর পেরিয়ে ইউরোপে প্রবেশের সময় ধরা পড়েছেন। আফগানিস্তান, সিরিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, মালি, আইভরি কোস্ট, ইরাক, গায়ানা ও সুদানের মতো যুদ্ধপীড়িত কিংবা দরিদ্র দেশের নাগরিকদের সাথে বাংলাদেশিদের এভাবে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা দেশকে ভাবমূর্তি সংকটে ফেলেছে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে অন্তত এক লাখ বাংলাদেশি ইউরোপে আশ্রয় চেয়েছেন। শুধু ২০১৫ সালেই আশ্রয়ের আবেদন করেন ১৮ হাজার বাংলাদেশি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর নাগরিকদের সাথে বাংলাদেশি তরুণদের ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকে বিদেশের মোহ বলছেন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান।
তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানোর বিপদ সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। অবৈধভাবে বিদেশেযাত্রা বন্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে ও সবচেয়ে জরুরি হলো- দালালচক্রকে ভাঙতে হবে।’