
করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ইতি মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। আক্রান্তর সংখ্যা ও সবচেয়ে বেশি গত একদিনে। করোনা প্রতিরোধে নেয়া হচ্ছে নানান পদক্ষেপ।
এদিকে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন। ক্ষুধা, অনিশ্চয়তা, চিকিৎসাহীনতার ভয় বাড়ছে। সামনে আরো বিপদের আশংকা করছেন অনেকেই।
সম্প্রতি সিপিডির এক গবষেণায় দেখা গেছে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় কমে যাওয়ার কারণে বর্তমানে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে সামনের সঙ্কট মোকাবিলায় অর্থনীতিবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ এবং দীর্ঘ হলে দেশের অন্তত সাড়ে ৩ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে এবং সামাজিক সংকট তৈরি করবে। আসছে সংকট মোকাবিলার জন্য এখনই ভাবতে হবে এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সরকার জোন ভিত্তিক যে লকডাউন শুরু করেছে তার পরিবর্তে আগামী ১৪ দিন পুরো দেশ জুড়ে দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, এই মুহূর্তের সংকটটাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবতে হবে। সরকারের পক্ষে সামনে হয় তো পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হতে পারে। এখন যেই উদ্যোগ নিতে হবে প্রথমে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন খাদ্য ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। আর জীবন-জীবিকার কোনো হিসাবই মেলাতে পারছে না নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তরা এখনো জমানো খাবার খেতে পারছে। জমানো অর্থ খরচ করতে পারছে। কিন্তু দুমাস যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে তাহলে তারাও সংকটে পড়বে। তাদের জন্যও এখনই ভাবতে হবে। সামনের দিনের জন্য সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। সামাজিক সংকট একবার তৈরি হলে সেটা কাটাতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। আর সামাজিক সংকট যে কোনো দেশের বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে সামনের দিনগুলোয় যেন কোনোভাবেই সামাজিক সংকট তৈরি না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ব বিদ্যালয় কলেজ হাসপাতালের সাবেক ভাইসচ্যান্সেলর ড. নজরুল ইসলাম বলেন, আসলে বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এখন অগ্রাধিকার হওয়া উচিত অবশ্যই মানুষের জীবন বাঁচানো। কারণ মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই। তবে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সেবা আবারও প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বিভিন্ন টিভি রিপোর্টে দেখছি মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভয় পাচ্ছে। তারা বাসাতেই অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক হাসপাতালগুলোতে শুধু ভিআইপি রোগীদেরকে ভর্তি করাচ্ছেন। ভিআইপি রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসাব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু করোনাভাইরাস ভিআইপি নন ভিআইপি কিছু বুঝে না। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় বৈষম্য দূর করে সব রোগীকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই মুহূর্তে নাগরিকদের করণীয় সম্পর্কে দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই কম বেশি জানা। আসুন, নিজে বাঁচি, অন্যকে বাঁচাই। করোনাভাইরাস সংক্রমণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ভয়াবহ দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছে। এখন এই খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং সেই বরাদ্দের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এত বড় সংকটের সময় বেসরকারি হাসপাতালের ভূমিকা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, এই মুহূর্তে সব নাগরিকের প্রধান কাজ হলো শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। যদিও ঢাকার মতো শহরে, যেখানে লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র এবং বস্তিতে বসবাস করে, সেখানে এটা কার্যকর করা বেশ কঠিন। দীর্ঘ ছুটিতেও মানুষকে রাস্তায় বের হতে দেখা গেছে। ঈদের মধ্যে ঝুঁকি বেশির ভাগই গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আমরা নাগরিকরা যদি সচেতন না হই তাহলে সরকার যতই কঠোর সিদ্ধান্ত নিক না কেন ফল হবে না। আমাদের এখানে স্বাস্থ্যের নীতি ও পরিকল্পনার অনেকগুলোই ভালো ছিল বা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্তটি ভালো লাগেনি। এর পর থেকেই কিন্তু সংক্রামণরে সংখ্যা বাড়ছে। আমি বলব, এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ্হম আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, নাগরিক তো আমরা সবাই, কিন্তু সচেতন কজন? আমরা যারা সচেতন নাগরিক, তাদের দায়িত্ব কম সচেতন নাগরিকদের সতর্ক করা, স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করা। এখানে বড় ধরনের ঘাটতি লক্ষ করি। সরকারের দেয়া বার্তাগুলো সব মানুষ সমানভাবে পাচ্ছে না বা তারা নিচ্ছে না। এর কারণ হতে পারে বিভ্রান্তি। এখনো সাধারণ মানুষের কাছে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়েছে এটা বলা যায় না। তাদের জানানো, বোঝানোর কাজটি আরো ধৈর্য ও পরিকল্পনার সঙ্গে করতে হবে।