করোনা সংক্রমণের বিস্ফোরণের আশংকা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের
জুনের তৃতীয় সপ্তাহ বিপজ্জনক

মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২০, ১৩:২৪

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে। গত ২৪ ঘন্টায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। একদিনে ৪৬ জনের মৃতের মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৯৫ জন।
এই সময়ে আরো ৩ হাজার ৪৭১ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা একদিনে সর্বোচ্চ। এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ৫২৩ জনে। গত ১০ জুন ৩ হাজার ১৯০ জন নতুন রোগী শনাক্তের তথ্য দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর, যা এতেদিন একদিনের সর্বোচ্চ ছিল। তার আগের দিন ৪৫ জনের মৃতের সেই রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীর সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা এভাবে বাড়তেই থাকলে সামনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। মহামারি সামাল দিতে এখনই হিমসিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। অভিযোগ আছে, রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। অক্সিজেন ও আইসিইউ বেডের জন্য মারা যাচ্ছেন অনেকেই।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটুকু সামাল দিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশে করোনার ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের হার এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লাফ দিয়ে বেড়ে যেতে পারে। তখন আক্রন্ত ও মৃত্যুহারও লাফ দিয়ে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সংক্রমণের হার দ্রুত কমাতে হবে। নতুবা সংক্রমণের বিস্ফোরণ হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন তারা।
দেশের কিছু মানুষ সচেতন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, কিছু মানুষ মানেন না, কিছু আছে তারা বোঝেনই না আসলে কী হচ্ছে এমন মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, মহামারি মোকাবিলার জন্য আমরা বেশি পদক্ষেপ নিতে পারিনি। যা করার দরকার ছিল সেটা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদেও স্বাস্থ্যখাত হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের জনগণ এখনো পুরোপুরি সচেতন নয়। যতক্ষণ না আমরা ব্যক্তিগতভাবে সচেতন না হবো ততক্ষণ পর্যন্ত সংক্রমণের হার বাড়তেই থাকবে।
তিনি আরো বলেন, যদি আক্রান্তের হার বাড়ে, তাহলে মৃত্যুর হারও বাড়বে। আমরা অনেক রোগীকে হাসপাতালে নিতে পারছি না। হাসপাতালে জায়গা নেই। যদি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তেই থাকে, তাহলে রোগীরা হাসপাতাল, অক্সিজেন ও আইসিইউ পাবে না। তখন মারা যাবে। তবে এখন যে মৃত্যুর হার দেখানো হচ্ছে, সেটা আরো বেশি হবে। কারণ অনেক মৃত্যুর খোঁজ আমরা পাচ্ছি না। এখন যে মৃত্যু হচ্ছে, সেটার বেশিরভাগ অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি মারা যাচ্ছে চিকিৎসার অভাবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সংক্রমণের হার না কমালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। মানুষ থেকে মানুষের সংক্রমণটা বন্ধ করার জন্য সামাজিক দূরত্ব বিধিনিষেধ বা লকডাউন, সেটা দ্রুত কার্যকর করা উচিত। কিন্তু তা হচ্ছে ধীরগতিতে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের এখানে মৃত্যুর হার এখনো কম। যে সব দেশে মহামারির বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেখানে হঠাৎ করেই মৃত্যুর হারটা বেড়ে গেছে। আমাদের এখনো আক্রান্তের বিস্ফোরণ ঘটেনি। তবে যে পরিস্থিতি, সেই বিস্ফোরণের আশঙ্কা রয়েছে।
পরিস্থিতিতে ঠিক কবে নাগাদ করোনায় আক্রান্তের হার কমতে পারে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, পরিস্থিতি উন্নতির নির্ভল করছে আমাদের কর্মকাণ্ডের ওপর। আমরা যদি ঠিকমতো লকডাউন করতে পারি, তাহলে কম সময়ে নেমে যাবে। লকডাউন এলাকায় যারা শনাক্ত তাদের আরোগ্য করতে হবে। তাদের থেকে যেন আর না ছড়ায়, সেজন্যই কিন্তু লকডাউন। তাই লকডাউন এলাকায় দ্রুত পরীক্ষা করে শনাক্ত করতে হবে।
করোনার ঝুঁকি এড়াতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে সবাইকে অনুরোধ করে লেলিন চৌধুরী বলেন, নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন, অন্যকেও সুরক্ষিত রাখুন। আপনার সুরক্ষা আপনার হাতে। কাজেই সুরক্ষার জন্য যেসব স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হয়, সেগুলো মেনে চলুন। সব সময় মাস্ক ব্যবহার করুন, বারবার সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। আর এই বিধিনিষেধগুলো মেনে না চললে করোনাভাইরাস মহামারির বিস্ফোরণ ঘটতে আমাদের দেশে খুব বেশি সময় লাগবে না।
এভাবে যদি রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে ভয়াবহ বিপর্যয় হবে মন্তব্য করে কভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, রোগী সংখ্যা বাড়লে তো হাসপাতালে জায়গা পাওয়াই কঠিন হয়ে যাবে। অলরেডি যেসব হাসপাতালে কভিডের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো ভর্তি হয়ে গেছে। জায়গাই তো খালি নাই। সরকারকে চেষ্টা করতে হবে। তারচেয়েও জরুরি, রোগের সংক্রমণ যাতে কমে সে ব্যবস্থা নেয়া। যেকোনোভাবেই রোগী সংখ্যা কম হোক এই প্রার্থনা করা উচিত। যেন হাসপাতালে যাওয়া না লাগে, যেন আইসিইউ না লাগে। এজন্য প্রতিকার, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতি জোর দিতে হবে বেশি, যাতে সংক্রমণের হার কমে যায়।
মানুষ কোনো নির্দেশনা মানছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, তারা প্রতিকার, প্রতিরোধ কিছুই নিচ্ছে না। এজন্য বিপর্যয় রোধে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সচেতন হতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিষেষজ্ঞ ফয়জুল হাকিম বলেন, এখনো করোনা নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি ও সময় আমাদের রয়েছে। এখনই যদি ঠেকাতে না পারি তাহলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। পাশের দেশ পাকিস্তানে অনেক বেড়ে গেছে। ভারতের মহারাষ্ট্রের ঘনীভূত মহামারির ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমাদের এখানেও ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে এবং চট্টগ্রামে একই রকম আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহটা আমাদের জন্য আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠতে পারে।