
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনা আইসোলেশন ইউনিটে আগুনের সূত্রপাত হয় ইউনিটের এসিতে বৈদ্যুতিক গোলাযোগ থেকে। আগুন লেগে পাঁচ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ।
প্রতিবেদনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি পেয়েছে তারা। বলছে, অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ জন মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।
বুধবার (১০ জুন) পুলিশের তদন্ত কমিটি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলামের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয়। শুক্রবার (১২ জুন) রাতে এ তথ্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ডিএমপি’র গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সুদীপ চক্রবর্তী।
গত ২৭ মে রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে ইউনাইটেড হাসপাতাল সংলগ্ন (মূল ভবনের বাইরে) করোনা আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লাগে। এ ঘটনায় সেখানে থাকা পাঁচ জন রোগীর সবাই মারা যান। এই ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
গত ৩ জুন সন্ধ্যায় রোনাল্ড রিকি গমেজ বাদী হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তার শ্বশুর ভেরুন অ্যান্থনি পল (৭৪) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতালের আগুনে মারা গিয়েছিলেন। মামলা দায়েরের ৮ দিনের মাথায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসি থেকেই ওই আইসোলেশন ইউনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ভিডিও ফুটেজ অন্যান্য আলামতের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে ডিসি সুদীপ কুমার বলেন, প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অবহেলা-গাফিলতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ভবনের ওই অংশটির অনুমোদনের বিষয়টি আছে। অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তা মোকাবেলায় প্রস্তুতির ঘাটতির বিষয়গুলোও উল্লেখ আছে।
পুলিশের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছিলো না। শুধু তাই নয়, আগুন লাগার পর যথেষ্ট সময় পেলেও হাসপাতালের কেউ তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেননি।
সুদীপ কুমার এ প্রসঙ্গে বলেন, হাসপাতালে আগুন লাগলেও ক্লিনার আরাফাত ছাড়া অন্যরা কেউ কোনো ভূমিকা পালন করেননি। আরাফাত শেষ পর্যন্ত একা লড়ে গেছেন। এ ঘটনায় তিনি পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ করেছেন। হাসপাতালের অন্য স্টাফরা পরে মেয়াদহীন ফায়ার এস্টিংগুইশার নিয়ে এলেও কোনো কাজ হয়নি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ২৪ ঘণ্টা ফায়ার সেফটি অফিসার ও কার্যকরি অগ্নিনির্বাপণ দল উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ঘটনার সময় তারা অনুপস্থিত ছিলেন। এর আগে ফায়ার সার্ভিসের তদন্তেও এসব বিষয় নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির বিষয়গুলো দেখা গেছে।
পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, হাসপাতালের অস্থায়ী আইসোলেশন ওয়ার্ডে অগ্নি নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। রাজউকের অনুমোদন না নিয়ে বা বিল্ডিং কোড না মেনে আর যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই আইসোলেশন ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আগুন লাগার পরপরই চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যরা রোগীদের সরানোর চেষ্টা না করেই নিরাপদে সরে পড়েন।
তদন্তে উঠে আসে, সাধারণত যে ধরনের আইসোলেশন ইউনিট ইউনাইটেড হাসপাতাল তৈরি করেছিল, সেই ধরনের স্থাপনায় অদাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়। তবে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাহ্য পদার্থ দিয়ে আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি করে। অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ইলেকট্রিক ক্যাবল, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ, স্যানিটাইজার বা অন্যান্য উচ্চ মাত্রার দাহ্য পদার্থের সমন্বয়ে আইসোলেশন সেন্টারটি স্থাপন করা হলেও ন্যূনতম সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি। পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনো ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা হয়নি। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চরম অবহেলার পরিচয় দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
এতে আরো বলা হয়, আইসোলেশন ওয়ার্ডের ভেতর দুটি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসক ও নার্সদের যে কক্ষ, সেখানকার এসি থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটে। আগুনে হাসপাতালে মারা যাওয়া পাঁচ রোগীর ৪ জনই বেড থেকেই নিথর হয়ে পড়েছিলেন। একজন ছিলেন দরজার কাছাকাছি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগুন লাগার পর আগুন নেভানোর ব্যবস্থা না করে এবং আইসোলেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীদের উদ্ধারে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চরম গাফিলতি, অবহেলা, উদাসিনতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও উপস্থিত নিরাপত্তাকর্মীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে রোগীর প্রতি চরম অবিচার করেছেন।