
সারাদেশ যখন করোনাভাইরাসের ধাক্কায় হিমশিম খাচ্ছে, সরকার প্রতিদিনই নিয়ম করে ক্রমবর্ধমান মৃত আর আক্রান্তের সংখ্যা ঘোষণা করছে, কোথায় লকডাউন কেমন হবে ও কীভাবে নির্ধারিত হবে লাল, হলুদ আর সবুজ- এ নিয়ে যখন সব মহলের চিন্তা; তখন নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলা চলে নীরবে-নিভৃতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের পথ আরো সংকুচিত করতে ঝুলিয়ে দিয়েছে হলুদ পতাকা।
কীভাবে তা হলো? গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের (আরপিও) যে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সারাদেশে সকল পর্যায়ের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে নারীর প্রতিনিধিত্ব ৩৩ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে। সেই অনুচ্ছেদটিই বাদ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
গত ১ জুন নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আরপিওর ৯০-এর খ-এর খ(২) অনুচ্ছেদটি বাতিলের প্রস্তাব করেছে কমিশন। রাজনীততে সক্রিয় নারীরা মনে করেন, এই প্রস্তাব অনুমোদন পেলে তা হবে রাজনীতিতে নারীর জন্য লাল পতাকা ও এর মধ্য দিয়ে নারীদের জন্য রাজনীতি পরিণত হবে কার্যত ‘রেড জোনে’।
নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আলমগীর সংবাদমাধ্যমকে জানান, ইসির প্রস্তাবে রয়েছে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলো আরপিও থেকে সরিয়ে এ সংক্রান্ত একটি আলাদা আইন করা। আর ৯০-এর খ-এর খ(২) অনুচ্ছেদটি বাতিলের বিষয়ে প্রস্তাব আসলেও তা এখনো অনুমোদন পায়নি। তাই এখনি এ বিষয়ে চূড়ান্তু করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
কী ছিল ইসির করণীয়
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত ৪১টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনোটিই নির্ধারিত ২০২০ সালের মধ্যে তাদের সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারিনি। আর যে কয়েক মাস সময় আছে, তাতে এই কাজ সম্পন্ন করা দলগুলোর জন্য প্রায় অসম্ভব। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো এই শর্তেই ইসির কাছ থেকে নিবন্ধন পেয়েছিল। তাই নিবন্ধনের শর্ত রক্ষা করতে না পারায় যেখানে ইসি দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা, সেখানে ইসিই চলছে ভিন্ন পথে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ইসির ভূমিকা মাথাব্যথা নিরাময়ের পথ না পেয়ে মাথা কেটে ফেলার মতো। গত ৮ মার্চ নারী দিবসের প্রাক্কালে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণ করতে না পারলে দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
আগেই ভিন্ন পথে আওয়ামী লীগ
আরপিও মানতে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য হলেও দলীয় কমিটিতে নারীর ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে আইনকে কোনো তোয়াক্কাই করেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে দলটি নিজের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে কমিটিতে নারীর ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সাল করে নেয়।
সে সময় এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি নূরুল হুদা বলেন, ‘আরপিওতে কোনো সংশোধন আসার আগেই দলীয় গঠনতন্ত্রে সময় বাড়িয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ ঠিক কাজ করেনি। কোন দল কি করল, তা দেখবে না নির্বাচন কমিশন। ইসি আরপিও অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’
কতটুকু বাস্তবায়ন হলো
নির্বাচনী আইন মানতে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সময় রয়েছে আর ৬ মাস। এই বিধানটি প্রবর্তিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। সে হিসেবে দেখা যাচ্ছে, এক যুগ সময় পার হলেও দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে নিবন্ধনের অন্যতম এই শর্ত পালনে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, সব স্তরে ১৫-২০ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব আনতে পেরেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো বড় দলগুলো, যাদের শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন নারীরা।
ইসির উদ্যোগ নিয়ে কি বলছে রাজনৈতিক দলগুলো
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘শর্ত পূরণে দলগুলোর কাছে এখনো ৬ মাস সময় রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। ইসির উচিত সময় পার হওয়ার পরে দলগুলোর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া। কেন তারা পারেনি বা এ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কি- সেটি জানতে চাইতে পারে। এসব না করে তারা শর্তটি তুলে দেয়ার প্রস্তাব করে নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে মাত্রা নির্ধারণের তুলনায় মানসিকতায় পরিবর্তন প্রয়োজন।’
সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিতরা রাজনীতিতে টিকতে পারছেন না এমন মন্তব্য করে আমির খসরু বলেন, ‘সংরক্ষিত নারী আসন এখন পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এজন্য রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকদের সাথে আলোচনা প্রয়োজন।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন আরপিওতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তে এই ধারাটি সংযোজনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ১৩ ভাগ। সর্বশেষ কমিটিতে এই হার ২৪ ভাগ। তাই এই শর্তটি বহাল রাখতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আইনে ৩৩ ভাগের কথা বলা হলেও এটি ৫০ ভাগ হওয়া উচিত। কারণ দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। ওই সময়ে এটি করার কারণ ছিল জেন্ডার সমতা সৃষ্টি করা। তা ছিল অন্তর্বর্তী লক্ষ্য।’
কীভাবে আইনে যুক্ত হলো এই শর্ত
২০০৮ সালে আরপিও সংশোধনের সময় রাজনৈতিক দল যেসব শর্তে নিবন্ধন পাবে তার একটি শর্ত হিসেবে এই অনুচ্ছেদটি যুক্ত হয় বলে জানা যায়। সে সময় নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এই আইনটি প্রণয়ন খুব সহজসাধ্য ছিল না। ওই সময়ে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনকে বাধা দেয়া হয়েছিল। অনেক ইসলামী দল কমিশনারদের মুরতাদ ঘোষণা করার হুমকি দিয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে, ভালো পরিবর্তনগুলো যাতে নষ্ট না হয়। এই শর্ত তুলে দিলে ইসি তার নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারবে।’
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে এই শর্ত দলগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলে ৫ বছর বাড়ানো যেতে পারে। ইসির উচিত ছিল প্রতি বছর দলগুলোকে চিঠি দিয়ে বাস্তবায়ন অগ্রগতি জানতে চাওয়া। তা করা হয়নি।’
রাজনৈতিক দল ও নারী নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সবাইকে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। কোনোভাবেই ইসিকে এই কাজটি করতে দেয়া যাবে না।’
কি বলছেন নারী অধিকার কর্মীরা?
নারী প্রগতি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন কেন ও কি কারণে এই অনুচ্ছেদটি বাতিল করতে চায়, তা জানা প্রয়োজন।’
ইসির এই উদ্যোগের খবর শুনে তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী ও কয়েকজন নারী এমপির সাথে আলাপ করেছিলেন। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন।
রোকেয়া কবির বলেন, ‘সংবিধানে সবার জন্য সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যান তারা এটি বাস্তবায়ন করে এই সমতা বিধান করবেন। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী ৫০ ভাগ হওয়া উচিত। এটা হচ্ছে না, কারণ দেশে কোনো প্রতিষ্ঠানের আচার আচরণেই গণতন্ত্র নেই। সেটা রাজনৈতিক দল হোক আর বেসরকারি সংস্থা হোক।’