
নির্ধারিত সময়ে ভোট আয়োজনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও করোনাকালে আটকা পড়েছে সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক নির্বাচন।
একের পর এক জনপ্রতিনিধির মৃত্যুর ঘটনায় বেড়েই চলেছে এই শূন্য আসনের সংখ্যা। সর্বশেষ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে শূন্য তালিকায় যুক্ত হলো আরো একটি সংসদীয় আসন।
সব মিলিয়ে বর্তমানে সংসদের পাঁচটি আসনের উপনির্বাচন ও চট্টগাম সিটি করপোরেশনে ভোটের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের একশর মতো পদে নির্বাচন করাতে হবে। চলতি জুন মাসের শেষ নাগাদ আরো কিছু স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করার আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ইসির ক্যালেন্ডারে গোলমাল
ইসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরজুড়েই দেশের কোথাও না কোথাও উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের কিছু কিছু পদে ভোট আয়োজনের বিষয়টি ইসির কালেন্ডারে থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে নির্বাচনী জটে পড়ছে তারা। ইতিমধ্যেই শূন্য অবস্থায় পড়ে আছে দেশের পাঁচটি সংসদীয় আসন। পেরিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিনক্ষণও। কবে, কখন এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তার স্পষ্ট জবাব নেই কমিশনের কাছেও।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ আলমগীর জানিয়েছেন, মহামারির কারণে দেশে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি শেষ হলেও সকল কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। নির্বাচন করার কোনো পরিস্থিতি এখন নেই। করোনাভাইরাস সংকট নিরসন হলে এসব নির্বাচন নিয়ে কমিশনে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তখন অবশ্য একই সময়ে একাধিক নির্বাচনে যেতে হবে। অন্যথায় এই জট কাটানো সম্ভব হবে না।
ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদের বর্তমান শূন্য আসনগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ-১, বগুড়া-১, যশোর-৬, পাবনা-৪ ও ঢাকা-৫। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সাথে বগুড়া-১ ও যশোর-৬ সংসদীয় আসনের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল গত ২৯ মার্চ। করোনাভাইরাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা থাকায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে তা স্থগিত করতে বাধ্য হয় ইসি।
গত ১৩ জুন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে সিরাজগঞ্জ-১, ১৮ জানুয়ারি সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের মৃত্যুতে বগুড়া-১ ও ২১ জানুয়ারি সংসদ সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুতে যশোর-৬ আসন শূন্য হয়। এছাড়াও পাবনা-৪ আসনের (আটঘরিয়া-ঈশ্বরদী) সংসদ সদস্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গত ২ এপ্রিল। ঢাকা-৫ আসনের (ডেমরা-দনিয়া-মাতুয়াইল) সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান মোল্লা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গত ৬ মে।
সংবিধান কী বলে?
সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী সংসদীয় আসন শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে উপ-নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মনে করলে ‘দৈব-দুর্বিপাকের কারণে’ এই সময় তিনি আরো ৯০ দিন বাড়াতে পারবেন। এরপর কি হবে, এমন কোনো নির্দেশনা সংবিধানে নেই। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে বগুড়া-১, যশোর-৬ সংসদীয় আসনে সেই নির্দেশনা মানা সম্ভব হয়নি। নির্বাচন আয়োজনের ৯০ দিনের বাধ্যবাধকতা গত এপ্রিলেই শেষ হয়েছে। পরের ৯০ দিন শেষ হবে আগামী জুলাইয়ে। এই দুটি আসনের উপনির্বাচন করতে কমিশন আগামী জুলাই পর্যন্ত সময় পাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় পরের ৯০ দিনের মধ্যেও নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে ইসির কর্মকর্তারা সন্দিহান।
ইসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাঁচটি শূন্য আসনের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জুলাইয়ের মধ্যে পাঁচটি সংসদীয় আসনের মধ্যে দুটি ও চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচন আয়োজন না করতে পারলে এক ধরনের জটিলতায় পড়বে কমিশন।
এর আগে গত মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচন কমিশন। সে সময় ওই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনায় পড়ে ইসি। ঢাকা-১০ আসনে খুবই কমসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি ঘটে।
এদিকে স্থানীয় সরকার পরিষদের বিভিন্ন স্তরের অর্থাৎ জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের একশ’র মতো পদ মৃত্যু ও বরাখস্তসহ বিভিন্ন কারণে শূন্য হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট পরিষদগুলোর নিজস্ব আইনানুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়াও বেশকিছু পরিষদের পাঁচ বছরের নির্ধারিত মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এসব কারণেই নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজন রয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজন না করা গেলে একদিকে যেমন আইনি নির্দেশনা অমান্য হচ্ছে। অনদিকে ইসির বার্ষিক নির্বাচনী কালেন্ডারে হ-য-ব-র-ল অবস্থার তৈরি হবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সংসদের উপ-নির্বাচনগুলো নিয়ে সাংবিধানিক নির্দেশনা মেনে চলার বিষয় রয়েছে; কিন্তু স্থানীয় সরকার পরিষদের ভোটগুলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শ করে পিছিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ বিষয়ে আলোচনা করে কৌশল নির্ধারণ করা হবে। তবে অল্প সময়ে অনেকগুলো নির্বাচন করেত গিয়ে কমিশনের কর্মকর্তাদের ওপর হয়ত একটু বেশি চাপ পড়বে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সবাই অনুধাবন করতে পারছেন। তাই কমিশনের বিশেষ কিছু করার নেই।’
রাষ্ট্রপতির পরামর্শ নেবে ইসি
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই নির্বাচনী জটিলতার অবসান ঘটাতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার পরামর্শ চাইতে পারে ইসি। ঈদুল ফিতরের আগে ইসির এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে। সে সময় একটি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানেও এ বিষয়ে কথা বলেছেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা।
তখন তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদেও কোনো আসন শূন্য হলে ৯০ দিনের মধ্যে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দৈব দুর্বিপাকে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব না হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজস্ব ক্ষমতাবলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ভোট করতে পারেন। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিইসিকে সংবিধানের এ ক্ষমতা দিয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব না হলে নির্বাচন কমিশন মহামান্য রাষ্ট্রপতি সাথে পরামর্শ করে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করে পরামর্শ চাইতে পারে। এই সুযোগ রয়েছে।’