
করোনাভাইরাসের পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে ও নারী ও মেয়ে শিশুরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। ‘করোনা সংকট: চট্টগ্রামে করোনা মহামারি চলাকালীন সময়ে পারিবারিক সহিংসতা’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা সভায় এ তথ্য উঠে আসে।
চিটাগাং সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (সিএসডিএফ) ও আমেরিকান কর্নার চট্টগ্রামের উদ্যোগে মঙ্গলবার (২৩ জুন) এ অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সিএসডিএফ’র চেয়ারপার্সন এস এম নাজের হোসাইনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত অনলাইন সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকার স্টেপস এর প্রোগ্রাম কোঅরডিনেটর চন্দন লাহড়ী।
আলোচনায় অংশ নেন ইলমার প্রধান নির্বাহী জেসমিন সুলতানা পারু, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর আবিদা আজাদ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু, কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক জেমস গোমেজ, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের পরিচালক অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপিকা লতিফা কবির, এডাব ঢাকার পরিচালক এ কে এম জসিম উদ্দীন, আনসার ১৫ ব্যাটেলিয়ন পটিয়ার পরিচালক আজিম উদ্দীন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এম নাসিরুল হক।
এতে আরো অংশ নিয়েছেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী সদস্য মহররম হোসাইন, দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনের স্টাফ রিপোর্টার চৌধুরী মাহবুব, আনসার ১৫ ব্যাটেলিয়নের মানবাধিকার উপদেষ্টা কানিজ ফাতেমা লিমা, সংসপ্তকের প্রধান নির্বাহী লিটন চৌধুরী, মাইশার প্রধান নির্বাহী ইয়াছিন মঞ্জু, হেলপ ককসবাজারের প্রধান নির্বাহী আবুল কাসেম, নারী নেত্রী নাসিমা শওকত, নাদিরা সুলতানা হেলেন, সুচিত্রা গুহ টুম্পা, নাসরিন আকতার প্রমুখ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আমেরিকান কর্নার চট্টগ্রামের সহকারি পরিচালক রুমা দাস।
মূল প্রবন্ধে চন্দন লাহড়ী বলেন, স্টেপস ও সিএসডিএফ এর পক্ষ থেকে দেশের ১২টি জেলায় সমীক্ষায় দেখা গেছে করোনাকালীন সময়ে পারিবারিক সহিংসতা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আর লকডাউনের কারণে নারীরা ঘরের বাইরে যাওয়া কমালেও ঘরে তাদের উপর দায়িত্ব অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আর অধিকাংশ নারীরা কর্মহীন হবার কারণে তাদের আয় রোজগার কমে যাওয়ায় পরিবারে অনেকেই নিগ্রহের শিকার। আর নারীর আয়-রোজগার কমায় তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
মানবাধিকার কর্মী জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, করোনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও হয়রানি বেড়ে গেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে তরুণ জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করার আহবান জানান তিনি। একই সাথে সহিংসতা প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো সক্রিয় করার পরামর্শ দেন।
অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু বলেন, নারীর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের উপর সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। একসময় নারী নির্যাতন ঘটলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। এখন এনজিওগুলোর তহবিল সংকটের কারণে এ ধরণের কর্মসূচি আয়োজন করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ধরনের কাজে তহবিল বরাদ্দ দরকার।
কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক জেমস গোমেজ বলেন, করোনায় প্রকৃতপক্ষে কী কী ধরণের সহিংসতা হয়েছে তার পরিসংখ্যান বের করা দরকার। বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে সম্পদের বণ্টন ও বিনিময় বাড়ানো যেতে পারে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের পরিচালক অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, করোনায় ভুক্তভোগী আইনি সেবা প্রার্থীরা আরও ভোগান্তির শিকার। মামলায় প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। আদালতগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক না হলে এই সমস্যা আরও বাড়বে।
প্রবীণ সাংবাদিক এম নাসিরুল হক বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আরো ইতিবাচক হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। সেক্ষেত্রে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদেরকে আরও সক্রিয় ও সচেতন হতে হবে।
এডাব ঢাকার পরিচালক একেএম জসিম উদ্দীন বলেন, বিভিন্ন মিডিয়া ও গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে করোনা কালে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকগুণ বেড়েছে। তবে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধসহ করোনা মোকাবেলায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সরকারের সহযোগী হিসাবে যুক্ত করতে হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলো সরকারের সহায়ক ও পরিপূরক। করোনা মোকাবেলায় অনেকগুলি এনজিওর সম্পৃক্ততা না থাকায় জন অংশ গ্রহণ মূলক কর্মকাণ্ড কম দেখা যাচ্ছে।
অন্যান্য বক্তারাও করোনাকালীন সময়ে সহিংসতা বন্ধের মুল কারণ হিসাবে পরিবারের আয় কমে যাওয়াকে মূল কারণ হিসাবে দেখছেন। আর ঘরে বাইরে নারীর কাজের চাপ, আয়ের চাপ, পরিবার সামলানোর মতো কাজের চাপে নারীরা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। তাই স্থানীয় ভাবে কাউন্সেলিং সেবা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
অনলাইন আলোচনা সভায় নির্যাতনের শিকার নারীদেরকে পুনর্বাসন ও মনো-সামাজিক সহায়তা প্রদান, সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমগুলিতে ইতিবাচক সংবাদ তুলে ধরার জন্য প্রচারণা কর্মসূচি পরিচালনা করা,তরুণ সমাজকে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলিকে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে অধিক মনযোগী হওয়া, সহিংসতা বন্ধে সরকারী হেলপলাইন ৯৯৯ ও ৩৩৩কে আরো জনপ্রিয় করা, সহজ শর্তে নারীদেরকে ঋণ প্রদান, সরকারী-বেসরকারি প্রণোদনা দিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরকে আত্মনির্ভর করা, করোনা মোকাবেলাসহ নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সরকারী উদ্যোগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে অধিক হারে যুক্ত করা এবং তহবিল বরাদ্দের দাবি জানানো হয়।