
সারা বিশ্বে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশেও সংক্রমণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তাই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার দেশের ১৯টি জেলার ৪৫টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব এলাকায় সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ এলাকায় ঢিমেতালে লকডাউন বাস্তবায়ন হচ্ছে। যার ফলে লকডাউনের মতো রেড জোন নিয়েও চলছে বিতর্ক।
কিছু এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করার অন্তত সপ্তাহখানেক পরে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এসব এলাকায় মানুষের অবাধ বিচরণ আগেও ছিলো এখনো আছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই যেমন প্রশাসনের কড়াকড়িও নেই তেমন একটা। কিছু কিছু এলাকায় বিভিন্ন অজুহাতে দোকানপাট, অফিস, ব্যাংক খোলা রাখা হয়েছে। লকডাউন করার পরেও রেড জোনের বাসিন্দারা তুচ্ছ প্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসছেন।
অন্য এলাকা থেকেও রেড জোনে প্রবেশ করছে। যদিও রেড জোনের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, লকডাউনে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটা পাচ্ছেন না। ওষুধপত্র থেকে শুরু করে জরুরি পণ্যও তাদেরকে সরবরাহ করা হচ্ছেনা।
লকডাউন ও সাধারণ ছুটি নিয়ে যেমন বিতর্ক ছিলো এখন রেড জোন নিয়ে বিতর্ক চলছে। তুলনামূলক কমরোগী আছে এমন এলাকাগুলোকে রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ সরকার রেড জোন ঘোষণা করেছে এমন এলাকার বাইরের কিছু এলাকাতে আরো বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। সারা দেশের মোট শনাক্ত রোগীর অর্ধেকের বেশি ঢাকায় হলেও এখনো ঢাকার একটি এলাকা ছাড়া আর কোথাও লকডাউন কার্যক্রম শুরু হয়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ঢাকাকে রেড জোন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। তার আগে কোন কোন এলাকা রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হবে সেটি চূড়ান্ত করে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ অফিস আদালতের পাশাপাশি কলকারখানা, শিল্পাঞ্চল রয়েছে। এসব চিন্তা করেই সময় নেয়া হচ্ছে। যাতে করে এসব এলাকাগুলোকে বাঁচানো যায়। সব জায়গায় একসঙ্গে লকডাউন করা হবে না।
দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পরে সাধারণ ছুটির নামে দুই মাস পুরো দেশ সাধারণ ছুটিতে ছিলো। পরে ৩১ মে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক করে দিয়ে বিধি নিষেধ তুলে নেয় সরকার। পরে হু হু করে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর শনাক্ত, মৃত্যু ও শহরের ঘনত্ব বিবেচনা করে লাল, সবুজ ও হলুদ জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
রেড জোন করা হয়েছে এমন জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, বগুড়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, মাগুরা, নরসিংদী, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর।
এদিকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জাতীয় কারিগরি কমিটি ঢাকা শহরে ৪৫টি, চট্টগ্রামে ১১টি এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকাকেও রেড জোন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এমন অবস্থায় ২১ জুন রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২৭টি রেড জোন এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।
গত মঙ্গলবার আবার ৪ জেলার ৭টি রেড জোনে ছুটি ঘোষণা করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন দিনে দেশের ১৯টি জেলার ৪৫টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে এসব এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে রবিবার চট্টগ্রাম, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, যশোর ও মাদারীপুরের ২৭টি রেড জোনে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
সোমবার ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, বাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী ও কুষ্টিয়ার ১১ টি রেড জোনে ছুটি ঘোষণা করা হয়। মঙ্গলবার কক্সবাজার, মাগুরা, খুলনা ও হবিগঞ্জের ৭টি জোনে ২৪ জুন থেকে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম একটি গণমাধ্যমকে বলেন, এলাকাভিত্তিক লকডাউনে কিছু আসে যায় না। যদি না লকডাউন ঠিকমত কার্যকর করা না হয়। কারণ লকডাউন বললাম আর কার্যক্রম করলাম না তা হবে না। এর আগেও আমরা লকডাউন ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি নাই।
তিনি বলেন লকডাউনের কয়েকটা নিয়ম আছে। সেটা হলো, রোগী শনাক্ত ও তাদের আইসোলেশন। বাসায় রাখলে ঠিকমত আইসোলেশন হয় না। রোগীদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে। যখন নেগেটিভ আসবে তখন ছেড়ে দিতে হবে। সঙ্গে তাদের সংস্পর্শে যারা ছিলো তাদেরকে কোয়ারেন্টিন করা। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
জেলা প্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য মতে, চট্টগ্রাম মহানগরীর ১০টি ওয়ার্ড ও জেলার ৯টি উপজেলা রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকাগুলো ক্রমান্বয়ে লকডাউন হিসেবে ঘোষণা করার কথা ছিলো। কিন্তু রোড জোন ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত লকডাউন বাস্তবায়ন করা হয়নি। শুধুমাত্র নগরীর একটি মাত্র ওয়ার্ডে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যদিও এই এলাকায় নামেই লকডাউন করা হয়েছে।
তবে কক্সবাজারের চিত্র ভিন্ন, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই কক্সবাজারের কিছু জায়গাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে কক্সবাজার সদর ও নতুন করে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা রয়েছে। এখানে প্রশাসনের কড়াকড়িতে ভালোভাবেই লকডাউন বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানে স্বেচ্ছাসেবকদের নামানো হয়েছে মাঠে। ঘর থেকে বাইরে বের হলে বা কোনো যানবাহন রাস্তায় নামলে সেচ্ছাসেবিরা বাধা দেয়। ফলে বাধ্য হয়েই অনেকে ঘরে অবস্থান করছে। শুধুমাত্র রবিবার ও বৃহস্পতিবার ব্যাংক ও হাটবাজার খোলা হয়। সপ্তাহের এই দুইদিনই এলাকার মানুষ বাইরে এসে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারেন।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলাকে পূর্ণ রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া হবিগঞ্জ সদর (আংশিক), বানিয়াচঙ্গ উপজেলার গ্রামীন ব্যাংক এলাকা, আজমিরীগঞ্জ সদর, বাহুবল সদর ও চুনারুঘাটের কয়েকটি ইউনিয়ন রেড জোনের আওতায় পড়েছে। রেড জোন এলাকায় নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। প্রশাসনেরও কোনো পদক্ষেপ নাই। স্বাস্থ্য বিভাগ, জেলা প্রশাসনের মধ্যে ঠেলাঠেলি চলছে।
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া পৌরসভার মাগুরা, কাদিপুর ইউনিয়নের মনসুর ও বরমচাল ইউনিয়নের নন্দনগর এলাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন করা হয়। এখন নতুন করে আবার গাজীপুর, কর্মধা, পৃথিমপাশা ও মনসুরপুর এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু এসব এলাকায় কেউ লকডাউন মানছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঁশ দিয়ে এলাকা নির্ধারণ করে দেয়া হলেও মানুষ বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে চলাফেরা করছে।
নারায়ণগঞ্জের ১৯টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে, নারায়ণগঞ্জ সিটির সাতটি ওয়ার্ড, সদর উপজেলার দুটি, বন্দরের ১টি, সোনাগাঁয়ের ২টি, আড়াইহাজারের ৩টি ও রূপগঞ্জের ৪টি ওয়ার্ড।
১৯টি জেলার ৪৫টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এখনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সংক্রমণ রোধে যে সকল সামাজিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রয়োজন সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণেরও সহযোগিতা এবং দায় আছে। কিন্তু জনগণ সহযোগিতা করছে না।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবি এবং ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে- সাধারণ লোক যারা বাইরে ঘুরছেন তারা ঠিকমত মাস্ক ব্যবহার করছেন না। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখাচ্ছে সেগুলো কতটুকু প্রতিপালন করছেন সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই রেড জোন করেও কোনো সুফল আসছে না।