
সারা বিশ্বে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সেই সাথে সংক্রমণ বাড়ছে বাংলাদেশেও। আসছে পবিত্র ঈদুল আযহা। করোনা সংক্রমণের মাঝে আসন্ন কোরবানির পশু নিয়ে তাই উদ্বেগ বাড়ছে। দেশে প্রতিবছর কোরবানিতে এক কোটির বেশি গবাদি পশুর চাহিদা থাকে। এর প্রায় অধিকটা পূরণ করে থাকেন দেশীয় খামারিরা। কোরবানির এখনো এক মাসেরও বেশি সময় বাকি। এই সময়ের মাঝে যদি করোনার প্রকোপ না কমে তাহলে খামারিদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতে পারে।
দেশের খামারিরা কোরবানির ৬-৭ মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেন। এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। কোরবানি ঈদের চার মাস বাকি থাকতেই শুরু হয় ভয়াবহ সঙ্কট। করোনা মহামারির এই সঙ্কটের কারণে ভেঙে গেছে খামারিদের মন।
জানা যায়, এবার দেশের খামারগুলোতে ৬০ লাখ গরু মোটাতাজাকরণে প্রস্তুতি ছিলো। তবে করোনার কারণে এই কাজে ভাটা পড়েছে। কোরবানির গরুর বাজার নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। তাদের অর্ধেক গরু বিক্রি হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন খামারিরা। গেলো কোরবানির ঈদে দেশীয় খামারিদের ৪৫ লাখ গরু বিক্রি হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এবার খামারে ৬০ লাখ গরু মোটাতাজাকরণের কাজ চলছিল।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সবকিছু বন্ধ থাকায় গো-খাদ্যের দামও চড়া হয়েছে। এক মাস আগে এক বস্তা (৩৭ কেজি) গমের ভুসির দাম ছিলো ১১শ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৪শ টাকা। শুধু গমের ভুসি নয়। সব গো-খাদ্যের দাম গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। পরিবহন সঙ্কটে গো-খাদ্যের অভাবও দেখা দিয়েছে।
বড় বড় খামারগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে গরু পরিচর্যাকারী শ্রমিকেরও। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো লিমিটেডে কোরবানির জন্য গড়ে প্রস্তুত করা হয় এক হাজার ৫০০ পশু। চড়া দামে গো-খাদ্য কিনে এসব পশুপালন করা হয়। এবার একটু বেশি গরু প্রস্তুত করা হচ্ছে। কিন্তু চলমান পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে অনেক বেশি লোকসান গুণতে হবে এই খামার মালিকের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে খামার এবং গৃহস্থ মিলে সাত লাখ পশু আছে। এসব পশু নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। অবশ্য জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্বেগের কারণ নেই। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এবং আসন্ন কোরবানিতে চট্টগ্রামে পশুর অভাব হবে না। তারা বলেছেন, কোরবানির বাজার সামনে রেখে সাত লাখেরও বেশি পশু প্রস্তুত করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৩৮টি খামার রয়েছে। এসব খামারে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। প্রতিটি খামারেই রয়েছে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া। খামারগুলোতে বিভিন্ন ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। দুই থেকে দশ কোটি টাকার গরু রয়েছে এমন অনেক খামার রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে হাজার হাজার পরিবারে গরু-ছাগল লালন পালন করা হচ্ছে। এনজিও সংস্থাসহ নানা খাত থেকে ঋণ নিয়ে অনেক কৃষক গরু-ছাগল পালন করে কোরবানির সময় বিক্রি করেন।
নাহার এগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রকিবুর রহমান টুটুল গণমাধ্যমকে বলেন, চট্টগ্রামে অনেক খামার। প্রতিটি খামারেই অনেক গরু তৈরি করা হয়েছে। নিজের খামারে চার শতাধিক গরু কোরবানির জন্য তৈরি করেছেন। একটি গরুর দাম দুই লাখ টাকা হলেও অন্তত আট কোটি টাকার গরু তিনি প্রস্তুত করেছেন। এভাবে প্রতিটি খামারে কোরবানির জন্য কোটি কোটি টাকার গরু-মহিষ পালন করা হচ্ছে।
অন্যান্য বছর আমেরিকা, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে এমন সময় গরু, উট, দুম্বা ও ছাগল উড়োজাহাজে করে আমদানি করা হত। তবে এবার সেই প্রস্তুতিও বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে সাদিক এগ্রোর মতো অন্যান্য খামারেও কোরবানির পশু মোটাতাজাকরণ নিয়ে উভয় সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, চলতি বছরে দেশীয় পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। চলতি সপ্তাহে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু নিয়ে একটা ডাটা প্রস্তুত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে মোট গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখ। সবমিলিয়ে এবারো কোরবানির জন্য ১ কোটি ২০ লাখের ওপরে প্রস্তুত রয়েছে। গত কোরবানির ঈদে ১ কোটি ১৭ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ প্রস্তুত ছিলো। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা ছিলো ৪৫ লাখ। কোরবানিতে পশু জবাই করা হয়েছিল ১ কোটি ৬ লাখ। ১০ লাখ পশুর যোগান বেশি ছিলো চাহিদা থেকে। সে হিসেবে এবারো বাইরের পশু ছাড়া চাহিদা মেটানো সম্ভব।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দাবি, করোনা ভাইরাসের কারণে কোরবানির পশু ৫ থেকে ১০ শতাংশ কম বিক্রি হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (খামার) ড. এ বি এম খালেকুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার ফলে দেশে লকডাউন চলায় গ্রামের প্রান্তিক এলাকা থেকে অনেক খামারে গরু আসতে সমস্যা হচ্ছে। সাপ্লাই চেইনের সংকট চলছে। আমাদের হাতে সম্প্রতি যে ডাটা এসেছে তাতে দেখা গেছে কোরবানির জন্য ৬০ লাখ গরু প্রস্তুত। তবে গত বছরের থেকে এবার কিছুটা কম কোরবানি হবে।
এদিকে আসন্ন ঈদুল আজহায় রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৪টি অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাট বসবে। এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১৪টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবে ১০টি। সেই সঙ্গে গাবতলীর স্থায়ী পশুর হাটেও চলবে কোরবানির পশু বেচা-কেনা। এরই মধ্যে হাট ইজারা চূড়ান্ত করতে দরপত্র আহ্বান করেছে ডিএসসিসি। আর ডিএনসিসি এখনও দরপত্রের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুই সিটি করপোরেশন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ জুন ১৪টি হাটের অস্থায়ী ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। দরপত্রে উত্তর শাহজাহানপুরের মৈত্রী সংঘ মাঠ এলাকার খালি জায়গার ইজারা মূল্য ধরা হয়েছে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৫৫৫ টাকা, যা গত বছর ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে।
হাজারীবাগের ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গার ইজারা মূল্য ১ কোটি ৭ লাখ ৬ হাজার টাকা, যা গত বছর ৯৮ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। কামরাঙ্গীরচরের ইসলাম চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে দক্ষিণ বুড়িগঙ্গা বাঁধ পর্যন্ত খালি জায়গা ৫ লাখ ৭২ হাজার ৪০০ টাকা, যা গত বছর ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়। পোস্তাগোলা শ্মশান ঘাট এলাকার খালি জায়গা ৩১ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা গত বছর ২৮ লাখ ৫ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়।
শ্যামপুর বালুর মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা ১ কোটি ২ লাখ ১১ হাজার ৩৩৫ টাকা, যার গত বছর সরকারি মূল্য ছিলো ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার ২৪৮ টাকা। কিন্তু হাটটির সরকারি মূল্য না পাওয়ায় ইজারা দেয়া হয়নি। পরে খাস আদায়ের মাধ্যমে এ থেকে রাজস্ব আদায় করে ডিএসসিসি।
মেরাদিয়া বাজারের আশপাশের খালি জায়গা ১ কোটি ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ টাকা। গত বছর হাটটি ইজারা দেওয়া হয় এক কোটি ৪০ লাখ ৫ হাজার টাকা। আরমানিটোলা মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা ১ কোটি ৬৫ লাখ ২৮ হাজার ৫৪ টাকা। গত বছর এই হাটটি ইজারা দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা।
গোপীবাগে বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা ৮৭ লাখ ২০ হাজার ৬৮৫ টাকা। গত বছর হাটটি এক কোটি ৮১ লাখ ৮১ হাজার ১৮১ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা ১ কোটি ৫৪ লাখ ৪০ হাজার ৬৬৭ টাকা, যার গত বছর হাটটি এক কোটি ১২ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়।
ধূপখোলা মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা ৪৬ লাখ ৮১ হাজার ৩৩৪ টাকা, যার গত বছর সরকারি মূল্য নির্ধারিত ছিলো ৩২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। আর ইজারা দেয়া হয় ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সাদেক হোসেন খোকা মাঠ সংলগ্ন ধোলাইখাল ট্রাক-স্ট্যান্ড এলাকা ২৬ লাখ ৮৭ হাজার ৮০৭ টাকা। গত বছর এর সরকারি মূল্য ছিলো এক কোটি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। আর ইজারা দেয়া হয়েছে এক কোটি ৬২ লাখ টাকা ৭৭ হাজার টাকা এবং ৫১০ টাকা।
আফতাব নগরের (ইস্টার্ন হাউজিং) ব্লক ই, এফ, জি ও এইচ এবং সেকশন-১ ও ২ এর খালি জায়গা ৬৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা, যার গত বছর সরকারি মূল্য ছিলো ৬৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা, আর ইজারা দেওয়া হয়েছে ৭০ লাখ টাকায়। আশুলিয়া মডেল টাউনের খালি জায়গা ১১ লাখ ১৫ হাজার ৬৫০ টাকা, যার গত বছর সরকারি মূল্য ছিলো ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু এই দর কেউ না দেয়ায় পরে হাটটিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খাস আদায় করে ডিএসসিসি। এতে মাত্র ৬ লাখ টাকা রাজস্ব পাওয়া যায়। লালবাগের রহমতগঞ্জ খেলার মাঠের আশপাশের খালি জায়গা ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৫০ টাকা। গত বছর এর সরকারি মূল্য ছিলো ১০ লাখ ৭০ হাজার ১২৩ টাকা। হাটটি ইজারা হয়েছে ১২ লাখ ৭ হাজার ১৫০ টাকায়।
ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ডিএনসিসি এলাকায় ১০টি অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে হাটগুলো এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।
এদিকে সকল স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব মেনেই এ বছর পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে পশুর হাট বসবে। পশুর হাট বসবে সুনির্দিষ্ট জায়গায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পশুর হাট বসবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
সচিবালয়ে নিজ কক্ষে বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) এ সংক্রান্ত এক অনলাইন মিটিংয়ে এ কথা জানান তিনি বলেন, পশুর হাটের নিরাপত্তায় প্রারম্ভিক সভা করেছি। এছাড়া আরো কিছু সভা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি সভা করেছে।এ সময় সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন অনলাইন মিটিংয়ে।
কোরবানি পশুর হাট নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নড়ে চরে বসলেও করোনাভাইরাসের কারণে কোরবানির পশু যদি ৫ থেকে ১০ শতাংশ কম বিক্রি হয় তবে তা খামারিদের জন্য চিন্তার কারণ হয়েই দাঁড়াবে।