Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

করোনা টেস্টের ফি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

Icon

লোকমান তাজ

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২০, ১৩:১১

করোনা টেস্টের ফি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে পরিপত্র জারি করেছে সরকার। এতদিন স্বাভাবিকভাবেই এই পরীক্ষার সুযোগ বিনামূল্যে থাকলেও এবার এখানে ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। করোনার সংক্রমণ দিন দিন বাড়তে থাকার প্রেক্ষিতে এবং করোনাকালে দেশের অধিকাংশ মানুষ আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ার সময়ে সরকার এই ফি নির্ধারণ করলো। এই ফি নির্ধারণ একদিকে যেমন বাস্তবতাবিবর্জিত অন্যদিকে দেশের করোনা সংক্রমণের বিস্তারের জন্যে সহায়ক হয়ে ওঠতে পারে।

সরকারি হাসপাতালে ও বুথে ফি ২০০, বাসাবাড়িতে ৫০০ আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ফি ৩৫০০ ও ৪৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরিপত্রে বলা হয়, কভিড-১৯ সংক্রমণ আরটি-পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। বর্তমানে এ পরীক্ষা সরকার বিনামূল্যে দিচ্ছে। ফলে কোনো উপসর্গ ছাড়াও অধিকাংশ মানুষ এ পরীক্ষা করানোর সুযোগ গ্রহণ করছেন। এমতাবস্থায় কভিড-১৯ এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অপ্রয়োজনীয় কভিড টেস্ট পরিহার করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে ফি নির্ধারণ করা হলো।

পরিপত্রে আরো বলা হয়, করোনা টেস্ট বাবদ আদায় করা অর্থ সরকারি কোষাগারে (কোড-১-২৭১৫-০০০০-১৮৬৩) জমা করতে হবে। চিকিৎসা সুবিধা বিধিমালা-১৯৭৪ এর আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের চিকিৎসা সংক্রান্ত সব সুযোগ বাহাল থাকবে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, দুস্থ ও গরিব রোগীদের চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত সরকারি আদেশ বহাল থাকবে। সব সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে এ হার নির্ধারণ করা হলো।

তবে ফি নির্ধারণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলছেন, করোনাকালে প্রায় ৩ কোটি মানুষ নতুন দরিদ্র। করোনা পরীক্ষায় ফি নির্ধারণ দরিদ্র শ্রেণিকে হাসপাতাল ও বুথ থেকে দূরে রাখবে। বাড়বে সংক্রমণ ঝুঁকি। আবার এমন সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক ও সময়োপযোগী বলে উল্লেখ করেছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, এ সিদ্ধান্তে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার হার কমার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অহেতুক খরচও কমবে। তবে এতে পরীক্ষার হার কমে গিয়ে এ মহামারি আরো ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন কেউ কেউ। তারা বললেন, এর মাধ্যমে কতিপয় সুবিধাবাদী ব্যক্তির অপ্রয়োজনীয় নমুনা পরীক্ষা বন্ধ করতে গিয়ে দরিদ্র মানুষকে বেকায়দায় ফেলা হলো। 


ফি নির্ধারণ  বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মান্নান গণমাধ্যমকে বলেন, জনস্বার্থের কথা চিন্তা করেই এই ফি নির্ধারণ করা হয়েছে৷ এখন যাদের প্রয়োজন নেই তারাও বিনা কারণে একাধিকবার টেস্ট করাচ্ছেন৷ ফি নির্ধারণের ফলে যাদের প্রয়োজন নেই তারা আর টেস্ট করাতে যাবেন না৷

তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম৷ তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, একটা টেস্টের পেছনে সরকারের ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়৷ সেখানে ২০০ টাকা নিয়ে কতটা এগুবে? বরং ফ্রি থাকলে ধনী-গরীব সবাই টেস্ট করাতে যেতেন৷ এখন যার খাবারেরই সমস্যা তিনি কীভাবে টেস্ট করাতে যাবেন? সবাই টেস্ট করাতে না গেলে সমাজের আসল চিত্রটা জানা যাবে না৷ আর টেস্ট করানোর দায়টা তো স্বাস্থ্য বিভাগের৷ জনগণ বুথে এসে নমুনা দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করছে৷ তাহলে যে আপনাকে সহযোগিতা করছে, তার কাছ থেকে উলটো পয়সা নেবেন? আর এই সিদ্ধান্তটা অসাংবিধানিকও৷ সংবিধানে সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবার কথা বলা আছে৷ এখন এই সেবাটা আর সবার থাকলো না৷

ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এখন শুধু যাদের ফি দেয়ার ক্ষমতা আছে তারাই করোনা পরীক্ষা করবেন৷ যাদের সংসার চলছে না, ২০০ টাকা হলে ৫ কেজি চাল কিনতে পারেন- এমন কেউ আর পরীক্ষা করাতে যাবেন না৷ ফলে সমাজে করোনা বিস্তৃতির সঠিক চিত্রটা আর পাওয়া যাবে না৷ শুধুমাত্র পয়সাওয়ালাদের মধ্যে কী পরিমাণ বিস্তৃতি লাভ করেছে সেটাই জানা যাবে৷ সারাদেশের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে কোনো ধরনের পরিকল্পনার সুযোগও আর থাকলো না৷

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলালও মনে করছেন, ফি নির্ধারণ না করলেই ভালো হতো৷ তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বিনা কারণে অনেকেই টেস্ট করাচ্ছেন এটা যেমন সত্যি, তেমনি ২০০ টাকা দিয়ে টেস্ট করানোও অনেকের জন্য কঠিন৷ এটাও মানতে হবে৷ তারপরও আমি মনে করি, সরকার তো কতকিছুতেই ভরতুকি দিচ্ছে, তাহলে এই টেস্ট ফ্রি রাখলেই ভালো হতো৷

কভিড-১৯ টেস্ট করাতে সরকারের ফি নির্ধারণ করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। এই ফি অন্যায্য দাবি করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সব বিশেষজ্ঞ করোনা সংক্রমণ রোধে টেস্ট বৃদ্ধি করাকেই প্রধান উপায় বলছেন, সেখানে টেস্ট করাতে ফি ধার্যের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এতে নিম্নআয়ের মানুষেরা উপসর্গ থাকার পরও করোনা পরীক্ষা করাতে পারবেন না। তাদের চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন করা যাবে না। এতে সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকবে।


ফি নেয়ার সিদ্ধান্ত যখন আসলো তখন বাংলাদেশে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। দেশে কার্যত ঘোষিত লকডাউন নেই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের অনেকের মধ্যেও এই স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন নেই। প্রতিদিন দেশে নির্দিষ্ট সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে এবং প্রতিদিনই বিশ শতাংশের ওপর থাকছে করোনা শনাক্ত রোগী, প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর জানানো হচ্ছে বুলেটিনে। এমন অবস্থায় আমাদের যখন আরও বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার কথা ছিলো সেখানে সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এই করোনা পরীক্ষাকে দূরে ঠেলে দেয়ার প্রচেষ্টাটাই চোখে পড়ল।

দেশে প্রথম কভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা হয় ২১ জানুয়ারি৷ প্রথম দিকে শুধু রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পরীক্ষা করা হলেও সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এপ্রিলের শুরুতে ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো হয়৷ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ৷ এরপর ২৯ এপ্রিল প্রথমবারের মতো চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সুযোগ দেয় সরকার৷ পরে আরও কয়েকটি হাসপাতালে পরীক্ষা শুরু হয়৷ এসব হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার জন্য সাড়ে ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার৷ তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে বাসায় গিয়ে নমুনা নিলে সাড়ে ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে৷

বর্তমানে দেশের ৬৮টি ল্যাবে কভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে৷ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নমুনা পরীক্ষার কিট সরবরাহ করছে সরকার৷ এখন দৈনিক নমুনা পরীক্ষা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে৷ 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫