Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন

নয়া বিতর্কে ইসি

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২০, ১২:১২

নয়া বিতর্কে ইসি

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। কখনো নির্বাচন নিয়ে, কখনো নিজেদের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা বা বিরোধ নিয়ে এবং কখনো আইন-কানুন নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে দেখা গেছে ইসিকে। মহামারি পরিস্থিতির শুরুতে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা তোয়াক্কা না করেই কয়েকটি নির্বাচন ও উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশজুড়ে সমালোচিত হয়েছিল ইসি। আর এবার রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনের খসড়ায় অবাস্তব শর্ত জুড়ে দিয়ে করোনাকালে নতুন করে আলোচনায় কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি।

বর্তমানে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) থেকে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন সংক্রান্ত বিধানাবলি বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন আইন-২০২০ এর খসড়া প্রণয়ন করেছে ইসি, তাতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে কঠোর শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। আবার নতুন দলকে নিবন্ধন দিতে অবাস্তব শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা নিবন্ধন প্রত্যাশী কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে পূরণ করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।

গত ১৬ জুন এ ধরনের কঠোর শর্ত রেখে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন-২০২০ এর খসড়া প্রণয়ন করেছে ইসি। খসড়া আইনটি নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশের পাশাপাশি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানা গেছে কমিশন সূত্রে। দলগুলোকে প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে আগামী ৭ জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ই-মেইলের মাধ্যমে মতামত দিতে বলেছে কমিশন।

আইনে কী ছিল, কী হলো?

বর্তমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) অধীনে (ধারা ৯০অ-৯০ও) নির্ধারিত কিছু ধারার আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন দেয়া হয়। পাশাপাশি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাদ দিয়ে নতুন করে গণপ্রতিনিধিত্ব আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। রাজনীতিক দলের নিবন্ধনের জন্য প্রণীত খসড়া আইনে ১৬টি ধারা রয়েছে। এতে নিবন্ধন পেতে আরপিওর বিদ্যমান শর্তগুলোর বেশিরভাগই ঠিক রাখা হয়েছে। তবে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু শর্ত। বিদ্যমান বিধানমতে, নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ করতে পারলেই রাজনৈতিক দল নিবন্ধন যোগ্য বিবেচিত হয়; কিন্তু নতুন আইনে দলগুলোকে তিনটি শর্তের মধ্যে দুটি পূরণ করতে হবে বলে খসড়া আইনে বলা হয়েছে। যা বর্তমানে অনিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে পূরণ করা কার্যত অসম্ভব।

বিদ্যমান আইনে নিবন্ধনের জন্য যে তিনটি শর্ত রয়েছে তার একটি হচ্ছে নিবন্ধনে আবেদিত রাজনৈতিক দলকে স্বাধীনতার পর থেকে যে কোনো সাধারণ নির্বাচনে নিজস্ব দলীয় প্রতীকে অংশ নিয়ে অন্তত একটি আসনে জয়লাভ করতে হবে; কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে এ শর্তটিতে আরো কড়াকড়ি আরোপ করে বলা হয়েছে, নিবন্ধন পেতে আবেদন জমা দেয়ার তারিখ হতে পূর্ববর্তী দুটি সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে অন্তত একটি আসনে জয়লাভ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন আইনে এ শর্তটি কার্যত অবাস্তব। কারণ ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পদ্ধতি চালু হওয়ার পরে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর কোনোটিতেই অনিবন্ধিত কোনো দলের দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ ছিল না। ফলে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার পূর্ববর্তী দুটি নির্বাচনে অনিবন্ধিত কোনো দলের দলীয় প্রতীক নিয়ে একটি আসনে বিজয়ী হওয়ার শর্ত পূরণ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।

খসড়া নতুন আইনের দুই নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, উপরোক্ত সংসদ নির্বাচনের (পূর্ববর্তী দুটি) যে কোনো একটিতে দরখাস্তকারী দল কর্তৃক নির্বাচনে অংশগ্রহণকৃত আসনে প্রদত্ত মোট ভোটের শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট লাভ করতে হবে। এ শর্তটি বিদ্যমান আইনে থাকলেও দেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় অনুপোযোগী। এখানে স্পষ্টত অনিবন্ধিত কোনো দলের পক্ষে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ না থাকায় যেমন প্রথম শর্ত পূরণ করা কোনো অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জন্য অবাস্তব। ঠিক একই কারণে দ্বিতীয় শর্ত পূরণ করাও অসম্ভব। 

নিবন্ধন পেতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ জেলা এবং একশ’ উপজেলায় কমিটিসহ দলীয় কার্যালয় থাকার তৃতীয় যে শর্তটি দেয়া হয়েছে, সেটি কিছু ক্ষেত্রে কষ্টসাপেক্ষ হলেও বাস্তবায়নযোগ্য। অবশ্য এ বিধানটি বিদ্যমান আইনে হুবহু রয়েছে।

যা বলছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এ ধরণের বিধানকে অসাংবিধানিক এবং মানুষের রাজনীতি করার অধিকার খর্বের কারণ বলে মনে করেন। বাস্তবায়ন সম্ভব নয়- এমন শর্ত জুড়ে দেয়াকে হাস্যকরও মনে করেন তারা। এদিকে, খসড়া আইনে নিবন্ধিত দলগুলোর শর্ত পূরণ না হওয়া সাপেক্ষে কমিশন নিবন্ধন বাতিল করার যে বিধান যুক্ত করা হচ্ছে, তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা এ ধরনের বিধানের পক্ষে মত দিয়েও আইনটির অপব্যবহার যাতে না হয়, সে ধরনের সেফগার্ড আইনে থাকা জরুরি বলে উলেখ করেছেন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. সাখাওয়াত হোসেন এই তিনটি শর্তের মধ্যে কেবল তৃতীয় শর্তটিকে আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা চালু হওয়ার সময় প্রথম যে দুটি শর্ত ছিল তার যৌক্তিকতা ছিল। কারণ ওই সময় সবগুলো দলই ছিল অনিবন্ধিত। ফলে দলীয় প্রতীকে ভোট করে সংসদে আসনপ্রাপ্তি বা ভোটের একটি অংশ পাওয়ার শর্ত তখন অনেক দলেরই পূরণ করার মতো সামর্থ্য ছিল; কিন্তু ২০০৮ সালের পর কোনো নির্বাচনে অনিবন্ধিত দলগুলোর দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ হয়নি। কাজেই এখন প্রথম দুটি শর্ত অকার্যকর। ফলে এ ধরনের শর্তের কোনো যৌক্তিকতা নেই।’

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সংবিধানে সবারই রাজনৈতিক দল করার সুযোগ রয়েছে; কিন্তু এই শর্তগুলো সংবিধানের বিধানের পরিপন্থী। যে শর্ত তিনটি দেয়া হয়েছে, তার প্রথম দুটি মানতে হলে নতুন কোনো দল নিবন্ধিত হতে পারবে না। যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।’

যা বলছেন অনিবন্ধিত দলের নেতারা

খসড়া আইনের নিবন্ধনের শতের বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘অযৌক্তিক এবং অবাস্তব শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্বাচন কমিশন মূলত ক্ষমতাসীন দলগুলোর পক্ষ হয়ে কাজ করছে, কারণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো চায় না আরো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পাক। কারণ তাদের জনবিরোধী কর্মকাণ্ডে বিরক্ত মানুষ নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান চাইলেও তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন অতীতেও গণবিরোধী কাজ করেছে, এখনো করছে। দেশে রাজনীতির বিকাশে তাদের কাজ করার কথা থাকলেও, তা না করে রাজনীতিকে কিছু জনবিচ্ছিন্ন দলের হাতে কুক্ষিগত করে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত।’

রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন সংশোধন দাবি পরিষদের সদস্যসচিব হারুন অর রশীদ বলেন, ‘অতীতেও দেখা গেছে, বড় দলগুলো তাদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে এমন সব বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে, যাতে করে ছোট দলগুলোর রাজনৈতিক অধিকার খর্ব হয়। এবারও সেই এক কাজই হতে যাচ্ছে। এই ধরনের শর্ত না দিয়ে সরাসরি বলে দেয়া উচিত, আর কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পাবে না।’

যা বলছে ইসি

নির্বাচন কমিশন বলছে, এটি একটি খসড়া আইন। এর ওপর সবার মতামত চাওয়া হয়েছে। কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধানের সুযোগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘খসড়ায় নানা রকম দুর্বলতা থাকতে পারে। সে কারণেই এটি খসড়া। শর্তগুলো আবারও বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। আইনটি বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যুগোপযোগী হওয়া দরকার। তার জন্য যা করা দরকার, কমিশন করবে।’

এদিকে, নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর বলেন, ‘খসড়াটি যেহেতু মতামত বা পরামর্শ প্রদানের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে, সেহেতু আশা করা যায় সংশ্লিষ্ট এবং যে কোনো নাগরিক সুচিন্তিত মতামত প্রদান করে এই আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫