
দুই চালকের অসতর্কতায় বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চ ডুবে প্রাণ হারালেন ৩২ যাত্রী। গত ২৯ জুন সকালে ঢাকা নদীবন্দরের (সদরঘাট) খুব কাছাকাছি এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এ লঞ্চ দুর্ঘটনায় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। অতীতেও এমন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে; কিন্তু বেশিরভাগ নৌদুর্ঘটনাই তদন্ত ও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তদন্ত কমিটির সুপারিশও আলোর মুখ দেখে না।
এ ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হয় না বললেই চলে। কখনো কখনো দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা কিংবা সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দিয়েই দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়। পরে এই লঘু শাস্তিমূলক পদক্ষেপও উঠিয়ে নেয়া হয়। তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব সুপারিশ করা হয়, সেগুলোরও বাস্তবায়ন হয় না। আবার নৌদুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলাগুলোতে অভিযুক্ত প্রভাবশালী নৌযান মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের নৌ-আদালতে যথাযথ সাজাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে সতর্ক হচ্ছে না চালকরা এবং উদ্ধার কাজেও দৈন্য কাটছে না। সঠিক তদন্ত না হওয়ায় এসব দুর্ঘটনাও কমছে না। ফলে পাঁচ বছরের ব্যাবধানে দেশের নৌপথে ঘটল আবার বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় পদ্মা নদীতে ‘এমভি মোস্তফা’ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৭০ যাত্রী নিহত হন। ওই দুর্ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজনকে দায়ী করার পাশাপাশি মোট ২৪টি সুপারিশ করা হয়। যার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মায় ডুবে গিয়েছিল পিনাক-৬ যাত্রীবাহী লঞ্চ। সেই ঘটনায় মৃত্যু হয় ৪৮ জনের। ওই লঞ্চটির মতোই গত ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়া ‘মর্নিং বার্ড’ নামের লঞ্চটিও ছিল এমএল ক্যাটাগরির। দুর্ঘটনার দীর্ঘ সময়ের পর উদ্ধার করা হয় ‘মর্নিং বার্ড’। তবে ২০১৪ সালের সেই পিনাক-৬ উদ্ধার হয়নি আজও। এর আগেও দেশের বিভিন্ন নৌপথে ডুবে যাওয়া বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহী লঞ্চ রয়ে গেছে নদীর গভীরেই। পিনাক-৬ দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। এতে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও বৈরী আবহাওয়ার কথা উল্লেখ করা হলেও দায়িত্বে অবহেলার বিভিন্ন কারণে বিআইডব্লিউটিএ’র মাওয়া নদীবন্দরের পরিবহন পরিদর্শক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) শফিকুল হক ও যুগ্ম পরিচালক (নৌ-নিট্রা) রফিকুল ইসলামকে দায়ী করা হয়। ত্রুটিপূর্ণ নকশার ভিত্তিতে লঞ্চটিকে নিবন্ধন প্রদান ও বিধিলঙ্ঘন করে সর্বশেষ ফিটনেস (সার্ভে) দেয়ায় ওই সময়ের সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের (বর্তমান নৌপরিবহন অধিদপ্তর) প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম ও অধিদপ্তরের জাহাজ জরিপকারক মির্জা সাইফুর রহমানকেও দায়ী করা হয়। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে দুর্ঘটনার পরপরই এবং মির্জা সাইফুর রহমানকে পরে সাময়িক বরখাস্ত করে দায় সারা হয়। অবশ্য অতিরিক্ত যাত্রী বহনের দায়ে লঞ্চটির মালিক আবু বকর সিদ্দিক কালু ও তার ছেলে ওমর ফারুক লিমন গ্রেফতার হন। পরে তারা জামিনে মুক্তি পান। এ ছাড়া লঞ্চের মাস্টার মনিরুল মনি ও কাওড়াকান্দি ঘাটের ইজারাদার আব্দুল হাই সিকদারকে দায়ী করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে অনেক দুর্ঘটনার তদন্ত কাজ।
এদিকে, উদ্ধারকাজ পরিচালনায় ২০১৩ সালে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি-সংবলিত দুটি উদ্ধার জাহাজ সংগ্রহ করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এর আগে হামজা ও রুস্তমের সক্ষমতা কম থাকায় নতুন উদ্ধারযান দুটির ব্যবস্থা করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ওই দুটিকে কোনো বড় ধরনের উদ্ধারকাজে লাগানো যায়নি। এবারের দুর্ঘটনার পরও কাজে লাগানো যায়নি এগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল দুর্ঘটনার খবর পেয়েও নারায়ণগঞ্জ থেকে সময়মতো রওনা দিতে পারেনি উদ্ধারকারী জাহাজ। কয়েক ঘণ্টা পর রওনা দিয়ে ঢাকার কাছে এসে আটকে যায় বুড়িগঙ্গা সেতুতে। উচ্চতার কারণে সেতু পার করে ঘটনাস্থলে নেয়া যায়নি। বরং চেষ্টা করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেতু ও জাহাজ দুটিই। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘এবার দুর্ঘটনায় উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ঘটনাস্থল পর্যন্ত আসতে পারেনি সেতুর কারণে। ধাক্কায় সেতু ও জাহাজ দুটিই কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে শুনেছি।’
তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দুর্ঘটনার সঠিক তদন্ত ও তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছেই। বহুবার বলার পরও বেশিরভাগ লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করায় মূলত কিছুদিন পর পর এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।’ সরকারের উদ্ধার কাজেও দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত, গত ২৬ বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৬৬১টি লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাত হাজারেরও বেশি মানুষ। অবশ্য সরকারি হিসাবে এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৪৩১ এবং নিখোঁজ প্রায় দেড় হাজার। এসব ঘটনায় আড়াই শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও মাত্র চার-পাঁচটি কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। গত প্রায় ছয় বছরে দেশে সংঘটিত ১৩টি নৌদুর্ঘটনায় গঠিত ১৬টি তদন্ত কমিটির মধ্যে আটটিই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। আর স্বাধীনতার পর সংঘটিত নৌদুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে প্রায় ৯০০টি। তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে কয়েক হাজার মামলাও হয়েছে। তবে বড় ধরনের শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও খুব কম, মাত্র দেড় শতাধিক। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনও নৌদুর্ঘটনায় প্রকৃত দোষীকে আড়াল করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে দেশে নৌদুর্ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেলে লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে কমিটিগুলোর প্রতিবেদন আলোর মুখও দেখে না। কখনো কখনো একটি দুর্ঘটনার জন্য আলাদা আলাদা সংস্থার একাধিক তদন্ত কমিটিও হয়েছে। অথচ দোষীদের শাস্তি তো হয়ই না, উপরন্তু দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চগুলোকে সামান্য মেরামত করে এবং একই চালক ও কর্মচারীদের দিয়ে আবারও চালাতে দেখা গেছে।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবারের লঞ্চ দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে লঞ্চ দুর্ঘটনাটিকে পরিকল্পিত বলে মনে হয়েছে। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের চিহ্নিত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এবারের দুর্ঘটনা সম্পর্কে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, ‘তদন্তের আগে প্রকৃত ঘটনা বলা যাবে না। তবে ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, দুই লঞ্চের চালকের অসতর্কতার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ‘বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির যে ঘটনা ঘটেছে, তার ভিডিও দেখে বোঝা যাচ্ছে চালকের গাফিলতিতে দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। এর দায় মালিক-চালক এড়াতে পারে না। তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’