জুলাই মাসে করোনার সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২০, ১২:৫১

জুলাই মাসের শেষে মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা উদযাপিত হতে যাচ্ছে। দেশে করোনা রোগী যেভাবে শনাক্ত হচ্ছে, তাতে জুলাই মাস বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একদিকে মানুষজনের বাড়ি যাওয়া, অন্যদিকে কোরবানি দিতে পশু কেনা থেকে ব্যবস্থাপনার কারণে তারা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত হওয়া কভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৬২ হাজার ৪১৭ জন। মোট মৃত্যু হয়েছে ২,০৫২ জনের মৃত্যু হলো। রবিবারও ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো দেশে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখা গেছে, সংক্রমণের হার অনেকটা স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, অফিস আদালত, দোকানপাট ও গার্মেন্টস খোলার পর সংক্রমণের গতিপ্রকৃতির তারা গভীরভাবে নজর রেখেছেন এবং ঝুঁকির চূড়ান্ত পর্যায়ের মধ্যে সংগৃহীত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ একটা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
এএসএম আলমগীর বলেন, ভাইরাসের রিপ্রোডাকশান রেট যাকে আর-নট বলা হয়, দেশে গত দু সপ্তাহে এই হার ১-এর নিচে নেমে এসেছে, যেটা একটা পজিটিভ সাইন। আর নট দিয়ে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেন একজন মানুষ কতজনকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা রাখে। দেশে আর নট-এর হিসাব থেকে তারা মনে করছেন একজন আক্রান্ত ব্যক্তির যেহেতু এখন একজনের কম লোককে সংক্রমিত করার আশংকা, সেটা আশাব্যঞ্জক।
তিনি বলেন, তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা যেটা দেখছি, সবগুলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা একসাথে কার্যকর রাখলে জুলাইয়ের শেষ নাগাদ সংক্রমণ কমতে শুরু করবে। তবে তিনি এটাও আশঙ্কা করছেন, ঈদুল আযহার সময় গরুর হাট এবং ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসার প্রবণতা আবার বাড়লে সংক্রমণের এই স্থিতাবস্থা আবার ঊর্ধ্বগতিতে রূপ নিতে পারে। আমরা একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারি। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে যদি কোরবানি ঈদে গরুর বাজার এবং মানুষের দল বেঁধে বাড়ি যাওয়া চলে- সেটা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তখন আমরা আরেকটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারি। আবারো রোগীর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে।
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের চেয়ারপার্সন শারমিন ইয়াসমিনের মত কিন্তু ভিন্ন। তিনি বলেন, রোগের বিস্তৃতিটা একটু কমে গেলেও এখনো কিন্তু সেটা স্থিতিশীল না। একদিকে যেমন কোরবানির ঈদ আছে, সেই সঙ্গে অনেক স্থানে বন্যা হচ্ছে। সেটা কিন্তু আরেকটা ঝুঁকি। এক্ষেত্রে লোকজনের পক্ষে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলাটা খুবই কঠিন ব্যাপার।
তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, কোরবানির হাটগুলোয় যারা গরু কিনতে যাবেন বা যারা গরু বিক্রি করবেন, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে একটা সমন্বয় করতে হবে। এজন্য অনলাইনে গরু কেনা বা হাটে না গিয়ে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যারা কোরবানির মাংস পৌঁছে দিতে পারেন, তাদের সাহায্য নেয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদুল আযহার সময় যদি মানুষ সামাজিক দূরত্বের মতো বিষয়গুলো ঠিকভাবে মেনে না চলেন, স্বাস্থ্য সতর্কতা না মানেন, তাহলে তা করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, এখানে দুইটি বিষয় মিলিয়ে প্রভাব পড়বে, যার ওপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়া বা কমার বিষয়গুলো অনেকাংশে নির্ভর করবে। রাজাবাজারের মতো যেসব এলাকায় স্থানীয়ভাবে লকডাউন করা হচ্ছে, সেটা যদি একসাথে অনেকগুলো জায়গায় কার্যকর করা যায়, রোগীদের আইসোলেশনে রাখা যায়, তাহলে হয়তো সংক্রমণ রোধে সেটা সহায়তা করবে। কিন্তু কোরবানির হাটের কারণে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আবার একটা ঝুঁকি তৈরি হবে। যারা গরু নিয়ে এসব হাটে আসবেন, তাদের মাধ্যমে যেমন রোগ আসতে পারে, তাদের মাধ্যমে সেটা সারা দেশে ছড়িয়েও পড়তে পারে। তেমনি যারা গরু কিনতে যাবেন, তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে মাংস কাটাকাটি, মাংস সংগ্রহ যারা করবেন, তাদের মাধ্যমেও এটার বিস্তার ঘটতে পারে।
ফলে সংক্রমণের পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে, সেটা বোঝার জন্য ঈদুল আযহা পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয় মার্চ মাসের আট তারিখে। এরপর প্রায় চার মাস অতিবাহিত হতে চললো। সেই সময় বলা হয়েছিল, এপ্রিল মাসটা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে ক্রিটিক্যাল হয়ে উঠবে। তারপরে বলা হয়েছিল, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে মে মাস। এখন জুলাই মাসের কথা বলা হচ্ছে। এই দীর্ঘ চার মাস ধরে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ চলার কারণ কি?
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলেন, সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সঠিক সময়েই সাধারণ ছুটি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপরে ছোট ছোট অনেকগুলো অনিচ্ছাকৃত ভুল আমাদের হয়েছে।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলন, যেমন এপ্রিলের পাঁচ তারিখে গার্মেন্টস কারখানাগুলো শ্রমিকদের একদল মানুষকে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। আবার ফেরত গেলেন। সেটা একটা ঝুঁকি তৈরি হলো। আবার ২৬শে এপ্রিল থেকে ঘোষণা দেয়া হলো, গার্মেন্টস কারখানাগুলো স্বাস্থ্য বিধি মেনে মে মাসের দুই তারিখ থেকে খোলা যাবে। কিন্তু যারা স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারবেন না, সেসব গার্মেন্টও ২৬ তারিখ থেকে খুলে গেল। হাজার হাজার শ্রমিক আসলেন। তারপরে ঈদে শপিং মার্কেট খুলে দেয়া হলো। সেখানেও সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন নি। এই ভুলগুলো আমরা করেছি।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেন, সাধারণ ছুটি থাকলেও সেটি কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়ন না করার কারণে করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
এএসএম আলমগীর বলছেন, ঈদের আগে বা পরে সীমিত আকারে অফিস বা ব্যবসা খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই সীমিত আকারে শব্দটা আমরা বুঝতে পারছি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য বিধি মানে না। সারা শহরে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই, আবার হ্যান্ড স্যানিটাইজারের খরচ সবাই বহন করতে পারবেন না। সামাজিক দূরত্বের কথা বলি, কিন্তু বাংলাদেশে যখন শহরের পুরো কর্মকাণ্ড শুরু হয়, তখন তিন ফিট দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা একটা কঠিন কাজ।
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের চেয়ারপার্সন শারমিন ইয়াসমিন বলেন, আসলে লকডাউন একটা বৈজ্ঞানিক মেথড, কিন্তু পূর্ব রাজাবাজারের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের একটা অভাব ছিল, তাই সেটা সফল হয়নি। বাড়িতে বাড়িতে স্ক্রিনিং করা যেতো, কমিউনিটিকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করা যায়নি। প্রস্তুতির একটা ঘাটতি ছিলো বলে আমার মনে হয়। পরবর্তী স্থানীয় লকডাউনের ক্ষেত্রে এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভুল সংশোধনের জন্য তিনি পরামর্শ দেন।
তবে এএসএম আলমগীর বলেন, রাজাবাজারের রোগী বেড়ে গেছে, এটা সত্য নয়। রাজাবাজারে রোগী অলমোস্ট জিরোতে নেমে এসেছে। আপনি যদি সাকসেসফুল লকডাউনের কথা বলেন, তাহলে রাজাবাজার একটা উদাহরণ। টোলারবাগের মতো সফলতা আমরা রাজাবাজারেও পেয়েছি। কিছুদিনের ভেতর এ সংক্রান্ত বিস্তারিত জানানো হবে।-বিবিসি