Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদের বর্ণাঢ্য জীবন

Icon

লোকমান তাজ

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২০, ১৬:২০

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী  ড. এমাজউদ্দীন আহমদের বর্ণাঢ্য জীবন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ আর আমাদের মাঝে নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

১৯৩২ -২০২০ সাল। জীবন চলার এই দীর্ঘ সময়ে এই আদর্শবান শিক্ষক বহু কীর্তি গড়েছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কথা বলেছেন, নীতি বাতলে দিয়েছেন। সংকটে জাতিকে দিশা দিয়েছেন এই আলোকিত মানুষটি। দল-মত নির্বিশেষে সবার অতি আপন এমাজউদ্দীন আহমদ।

তিনি ১৯৩২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অধিভুক্ত মালদাহ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভারতের কিছু অংশ) জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে অবিভক্ত মালদার গোলাপগঞ্জ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন। স্নাতকে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন।

এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। দুটি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন। এরই ফাঁকে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেন।

প্রায় আড়াই দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। পাশাপাশি পালন করেছেন প্রতিটি প্রশাসনিক দায়িত্বও। ছিলেন বিভাগীয় প্রধান, মুহসীন হলের প্রভোস্ট, প্রক্টর, প্রো-ভিসি ও সবশেষে ভিসি। ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ছয় বছরের কর্মবিরতি শেষে ২০০২ সালে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের ভিসি পদে।

ড. এমাজউদ্দীন আহমদ পিএইচডি করেছেন ১৯৭৭ সালে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আশির দশকে তিনি জার্মানির হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সিনিয়র ফেলো ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ভিসির সঙ্গে যারা মিশেছেন, তাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করেন যে, মানুষটি অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। সদা দিয়েই গেছেন, তার মধ্যে পাওয়ার প্রত্যাশা ছিলো না বললেই চলে। এই জ্ঞানী মানুষটি বহু মানুষের জীবন গড়ার কারিগর। তার ছাত্ররা মন্ত্রিসভার সদস্য, রাষ্ট্রদূত, সচিব, রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিক।

এমাজউদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি ছিলেন নিরহংকারী। পরম মমতা দিয়ে মানুষকে কাছে টানতে পারতেন। দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হলেও তার কাছে এক্সেস ছিলো সবার।

গবেষক-পর্যালোচক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের। তিনি আমৃত্যু তুলনামূলক রাজনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে গবেষণা করে গেছেন। তার লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির বেশি। তার লেখা বই দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে তার প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক।

এমাজউদ্দীন আহমদ পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন নিয়মিত। রাষ্ট্রনীতি পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তার লেখা কলামের গভীরতা ছিলো অনেক।

এ ছাড়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোল্ড মডেল, শেরেবাংলা স্মৃতি স্বর্ণপদক, ঢাকা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ যুব ফ্রন্ট গোল্ড মেডেল, মহাকাল কৃষ্টি চিন্তা সংঘ স্বর্ণপদক, জাতীয় সাহিত্য সংসদ স্বর্ণপদক, জিয়া সাংস্কৃতিক স্বর্ণপদক, রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম স্বর্ণপদকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।

তার স্ত্রী সেলিমা আহমদ ২০১৬ সালে মারা যান। অধ্যাপক দিলরুবা শওকতা আরা ইয়াসমিন ও অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন তাদের দুই মেয়ে। দুই ছেলের মধ্যে জিয়া হাসান ইবনে আহমদ সরকারি কর্মকর্তা, তানভীর ইকবাল ইবনে আহমদ একজন চিকিৎসক।

শুক্রবার (১৭ জুলাই) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এমাজউদ্দীন আহমদের মৃত্যু হয়। তার মেয়ে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।  তিনি বলেন, গত দু’দিন ধরে তার শরীর খারাপ ছিলো। বমি হওয়ায় আমরা রাতেই ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে তিনি ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মারা যান।


অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে বিএনপি। তার মরদেহে দলের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি কিছুক্ষণ তার মরদেহের সামনে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে মির্জা ফখরুল বলেন, তিনি (অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ) এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবেন- এটা আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ কয়েকদিন আগে পর্যন্ত আমরা তার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি ভার্চ্যুয়ালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীর আলোচনায় এসেছিলেন। তার এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য একটি বিশাল বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করলো এবং তার এই শূন্যতা পুরণ হওয়ার নয়। 

প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন স্বাধীনতাকামী, গণতন্ত্রকামী মানুষের অভিভাবক। তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন নির্লোভ নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি সবসময় চেয়েছেন বাংলাদেশ একটা সত্যিকার অর্থে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হোক, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একটা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হোক, জনগণের মুক্তি হোক- এটাই উনি চেয়েছিলেন। তিনি সারাজীবনটা ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্রের জন্য তার লেখনি অব্যাহত রেখেছেন। তার জীবনের সমস্ত কর্মটাই ছিলো এই বাংলাদেশের জন্য।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫