
পাটের বিকাশ আর বাংলার বিকাশ এক সময় একই অর্থ বহন করত। এখনো আমরা জানি, বাংলাদেশের পাট বিশ্বমানের। বাংলাদেশের পাট শিল্পের অভিজ্ঞতা শতবর্ষ পুরনো। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিনকোড আবিষ্কারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন। অথচ সেই বাংলাদেশেই কেন পাট নানা বিড়ম্বনা ও লোকসানের শিকার হচ্ছে?
এই প্রশ্নের জবাব নানা সময়ে আমাদের সামনে এলেও এর সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বলতে গেলে অন্য যে কোনো শিল্পের তুলনায় পাট শিল্পকে এখানে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ গত বছর পাটের আঁশ ব্যবহার করে পচনশীল পলিমার ব্যাগ তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান। পাটের তৈরি এই ব্যাগ দেখতে পলিথিন ব্যাগের মতো মনে হলেও আসলে তা অনেক বেশি টেকসই ও মজবুত।
পাটের সূক্ষ সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি এই ব্যাগ কয়েক মাসের মধ্যে পচে মাটিতে মিশে যায়, যা পরিবেশদূষণ কমাতে সহায়ক। আমরা জানি, পরিবেশদূষণ কমানো সব দেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে পাঁচ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এর মাত্র এক শতাংশ পুনরায় ব্যহারের জন্য রিসাইক্লিং করা হয়, বাকি ১০ শতাংশ সমুদ্রে ফেলা হয়। যা বিশ্বকে ভয়াবহ এক পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে তুলেছে। তাই পলিথিনের ব্যবহার কমানোর জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে ম্যানডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছিল, পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পাটের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। ইউরোপে পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ ও পাটজাত মোড়কের ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। সুতরাং পাটজাত নানাবিধ সব পণ্য বাদ দিয়েও শুধু ব্যাগ উৎপাদন করে এবং দেশ-বিদেশে বাজারজাত করে লোকসানের হাত থেকে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।
অথচ শিল্প হিসেবে পাট যখন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারত, ঠিক তখন লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অন্তর্ভুক্ত ২৫টি পাটকল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে যদিও বলা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন ও রিমডেলিংয়ের জন্য উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে! এ কথার বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, দেশ-বিদেশে যখন পাটের চাহিদা বেড়ে চলেছে, চামড়া শিল্পের চেয়েও যখন পাট শিল্প এগিয়ে চলেছে, তখন ঠিক এই মহামারির মধ্যে পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ার কারণ কি?
এর আগে ২০০৮ সালে ১/১১ সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ছয় পাটকলের উৎপাদন বন্ধ করে ব্যক্তি খাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; ঠিক তখনই পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, চীন, ভিয়েতনামে অনেক নতুন নতুন পাটকল স্থাপন করা হয়েছে। আমরা জানি, বিশ্ব বাজারে পাটের ৯২% চাহিদা পূরণ করে ভারত ও বাংলাদেশের পাট। পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে বিশ্ব বাজারে কাঁচামাল হিসেবে বাংলাদেশের পাটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অথচ ভারতে পাটকলের সংখ্যা যেখানে ৯৬টি, সেখানে বাংলাদেশে এতগুলো পাটকল একসঙ্গে কেন বন্ধ হবে!
২০০৮ সলে ছয়টি পাটকল বন্ধ হলে কাজ হারিয়েছিল প্রায় নয় হাজার দক্ষ শ্রমিক। এবার পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ফলে কাজ হারাচ্ছেন ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিক। যদিও গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে তাদের প্রাপ্য মজুরি, শ্রমিকদের পিএফ জমা, গ্র্যাচুইটির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে; কিন্তু আমাদের যা বাস্তব অভিজ্ঞতা তাতে আমরা দেখি, বিভিন্ন সময়ে পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা আদায়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে। অনশন করতে হয়েছে। এমনকি আমরা দেখেছি, এই মহামারির সময়কালেও পাটকল শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ গুলি ছুড়েছে।
মূলত পাটকলগুলোর লোকসানের পেছনে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, আধুনিকায়নে গাফিলতি, বাজারজাতকরণে উদ্যোগের অভাব ইত্যাদি কারণ অনেকদিন থেকেই বিরাজমান ছিল। যে কারণে বিজেএমসির অবদান উৎপাদনের ৮.২১ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। রফতানিতে এ হার কমে ৪.৪ শতাংশ হয়েছে। এ জন্য নানা সময়ে শ্রমিক হয়রানি এবং বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের এই সংকটগুলোকে মোকাবেলার চেষ্টা না করে, এই অর্থনৈতিক সংকটকালে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া আন্তরিকতার পরিচয় বহন করে না। আরেকটু আন্তরিক হলে, শ্রমিকদের দুর্দশার কথা ভাবলে একে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো। এমনিতেই এ দেশের বেসরকারি শিল্পকারখানাগুলো নানাভাবে শ্রমিক ঠকানোর পাঁয়তারা করে থাকে।
সরকারি পাটকলগুলোতে যেখানে একজন শ্রমিক বেতন পান আট হাজার ৭০০ টাকা, সেখানে বেসরকারি পাটকলগুলোতে একজন শ্রমিক অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে মাসিক মজুরি পান মাত্র দুই হাজার ৭০০ টাকা। অর্থাৎ, বিজেএমসির শ্রমিকরা চাকরি হারানোর পর এখন তাদের মজুরি প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে যাবে। আর তাইতো শ্রমিক-কর্মচারী পরিষদ কিভাবে প্রযুক্তিগত নবায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে পাটকলের লোকসান কমানো যায়, তার একটি প্রস্তাব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করেছিল।
তারা এও প্রস্তাব করেছিল যে, এই নবায়নের সময় পাটকল চার মাস বন্ধ রাখা অবস্থায় তারা অর্ধেক বেতন নিতে প্রস্তুত। সেই হিসাবে এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেই এই পাটকলগুলোকে নবায়ন করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব ছিল; কিন্তু তাদের কথা মানা হয়নি। এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে নবায়নের পরিবর্তে বাজেটের পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বেসরকারীকরণের জন্য প্রস্তুত সরকার; কিন্তু কেন এই আগ্রহ?
এই মহামারি দুর্যোগের সময়ে দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ যেখানে নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছেন, সেখানে এতগুলো লোককে কর্মহীন করে দেওয়া পুঁজিতান্ত্রিক শোষণেরই নামান্তর। যেখানে শ্রমিক শোষণের কারণে বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টস কারখানাগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানায় নেওয়ার দাবি তোলা হয়, সেখানে লোকসানের অজুহাতে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো বিলুপ্ত করে মূলত দুর্বৃত্ত ও লুটেরাদেরই সুবিধা করে দেওয়া হবে।
আর যদি পাটকলগুলো অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাতে আর কখনো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা না হয়, তাহলে পাট শিল্প, পাট উৎপাদন তথা পাটজাত পণ্যের প্রসারে প্রতিবেশী দেশগুলোকে এগিয়ে দেওয়া হবে, যা হয়ে উঠতে পারে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাই বাংলার পাটের প্রসার ও ঐতিহ্য বহাল রাখতে প্রয়োজনে পাট উৎপাদনে ভর্তুকি দিয়ে, কৃষিজাত পণ্যের উন্নয়নে এ শিল্প টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশে এবং দেশের বাইরে পাটের বিপুল চাহিদাকে পূরণে, তথা পাট শিল্পের বিকাশে প্রয়োজন হবে সব রকম অনিয়ম ও দুর্নীতিকে হটিয়ে পাটকলগুলোর টেকসই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করা। পাটকলগুলোকে কৃত্রিম লোকসানের অংশীদার করার পেছনের শক্তিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েই পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব। একটু সদিচ্ছা থাকলেই পাটকল বন্ধ করা বা বেসরকারীকরণ করা থেকে সরে আসা সম্ভব বলেই বিশ্বাস।
লেখক: কথাসাহিত্যিক