Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

‘ত্রাণ নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই’

Icon

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২০, ২৩:০৩

‘ত্রাণ নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই’

ছবি: স্টার মেইল

আকাশে কালো মেঘ অথবা একটু জোরে বাতাস এলেই বুকে কাঁপন ধরে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের। না জানি কখন দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নেয় ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল, ঘেরের মাছ। 

সিডর, আইলা, বুলবুল ও সর্বশেষ আমফানের আঘাতে তছনছ হয়েছে দেশের বেশিরভাগ বাঁধ। এতে গত এক দশকে সারাদেশে অনেক পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। করোনাভাইরাস দুর্যোগের মধ্যে এবার আগাম বন্যায় দেশের ২২ জেলায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে। 

তারা বলছেন, এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? দুর্যোগ এলেই ত্রাণ নিয়ে হাজির হয় কিছু সংস্থা। এসব সহযোগিতায় সাময়িক দুঃখ-দুর্দশা দূর হলেও স্থায়ী সমাধান হয় না। তাই এবার দাবি উঠেছে- ‘ত্রাণ নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই’। যা কৃষকের প্রাণের দাবি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই এমন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন পোস্ট করেছেন। কেউ কেউ আবার বুকে-পিঠে এমন স্লোগান লিখে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে ন্যায্য দাবির কথা জানিয়েছেন।

সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড় আমফানের মতো বড় বড় দুর্যোগে প্রতি বছর সারাদেশের বেড়িবাঁধগুলো বিধ্বস্ত হয়। এজন্য প্রতি বছর বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার বাবদ বাজেটে মোটা অঙ্কের বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে বাঁধ সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারি এ বরাদ্দের বেশিরভাগ অর্থই নয়ছয় হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যেনতেন কাজ দেখিয়ে পকেট ভারি হচ্ছে এক শ্রেণির প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের। জরুরি কাজের অজুহাতে (ডিপিএম পদ্ধতি) অতীতে কোটি কোটি টাকার সংস্কার কাজ হয়েছে। অথচ ঝড়ে পানির চাপ বাড়লেই এসব বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। প্রতি বছর এভাবে বাঁধ সংস্কারের নামে দুর্নীতি হলেও এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজরদারি নেই বলে জানা গেছে। এ কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তারা। 

এদিকে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও বাঁধ সংস্কারে সরকারি বরাদ্দ থেমে নেই। উপকূলীয় জেলায় বাঁধ সংস্কারের জন্য শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার। আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জেলায় বাঁধ সংস্কার ও মেরামতের জন্য আবারো ডিপিএম পদ্ধতিতে কাজ শুরু হচ্ছে। সম্প্রতি একনেকে সাতক্ষীরায় লবণাক্ত পানির প্রবেশ বন্ধে ৪৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতি বছরই বিস্তীর্ণ এলাকা নদীভাঙনের শিকার হয়। প্রতি বছর এভাবে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয় আর ঘরবাড়ি, ফসলের জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ। এ বছরও জুন মাস থেকেই অনেক জেলায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে নদীভাঙন নিয়ে কাজ করছে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। সংস্থাটির পরিচালক মমিনুল হক সরকার বলেন, ‘ছোট নদীগুলোর ভাঙন ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ কিছুটা সক্ষম হলেও, প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি সমন্বিত পরিকল্পনা আর বরাদ্দের অভাবে বড় নদীর ক্ষেত্রে উদ্যোগগুলো সফল হয়নি। এছাড়া বেড়িবাঁধ সংস্কারে যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়, তা নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রতি বছর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। করোনাকালীন সংকটে এবার তারাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘অনেক নদীরই ভাঙন প্রবণতা থাকলেও, মূলত পদ্মা, মেঘনা, যমুনা- এই তিন নদীতেই সবচেয়ে বেশি ভাঙনের ঘটনা ঘটে। গত পাঁচ দশকে এসব নদীতে বাংলাদেশের দেড় লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি বিলীন হয়েছে। নদীতে যেসব জমি হারিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো কিন্তু উর্বর জমি, রাস্তা ঘাট, স্কুল-কলেজ, বাড়িঘরও রয়েছে। অপরদিকে যে জমি জেগে উঠছে, সেটি ব্যবহার উপযোগী হতে আরো অনেক বছর দরকার হবে।’

বন্যাকবলিত উত্তর ও উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন জেলার ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে বলেছেন, বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই এবার এমন বন্যা মোকাবেলার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে শাক-সবজিসহ বিভিন্ন শস্য ও মাছ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে উত্তরের জেলাগুলোতে এই বন্যা লম্বা সময় ধরে থাকতে পারে বলে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র পূর্বাভাস দিচ্ছে। যদিও দেশের উত্তরের জেলাগুলোর মানুষ প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে কমবেশি বন্যা মোকাবেলা করে থাকেন; কিন্তু এবার তারা প্রস্তুত হওয়ার সময়ই পাননি। বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই বন্যা আঘাত হানে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায়।

কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, তারা যখন করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের মাঝে রয়েছেন, তখন আগাম বন্যা আরো অসহায় পরিস্থিতিতে ফেলেছে। বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি, শাক-সবজি, ফসলের জমি সবকিছু ডুবে গেছে। অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে গরু-ছাগল নিয়ে উঁচু জায়গায় বা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘উজানে অতিবৃষ্টি হওয়ায় এবার বন্যার পানি খুব দ্রুত বাড়ছে। দেশের ভেতরেও ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। এ কারণে বন্যার পানি আরো নতুন নতুন এলাকায় দ্রুত ঢুকতে পারে।’

জানা গেছে, বাঁধ সংস্কারে যথাযথ তত্ত্বাবধান না হওয়ায় একই স্থানে বার বার বেড়িবাঁধ ভাঙছে। এতে সরকারের বরাদ্দ শত শত কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। দুর্নীতির সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনেক প্রকৌশলী ও ঠিকাদার জড়িত থাকলেও, তারা সবসময় থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, ‘সরকার প্রতি বছর যে বরাদ্দ দেয়, সেটি সামগ্রিক ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধের উন্নয়নের জন্য। প্রতি অর্থবছরের বাজেটে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় সেটি প্রয়োজনের দশ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধ থেকে শুরু করে আট হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নদী-তীরবর্তী বাঁধ ও আড়াই হাজার কিলোমিটার হাওর অঞ্চলের ডুবন্ত বাঁধ সংস্কারে সরকার এই অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘নতুন প্রকল্পগুলো পাস হলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ কাজ শুরু হতে পারে এবং সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে বড় বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এটি প্রতি বছর চলতেই থাকবে। এজন্য আমরা বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এগুলো ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হবে। এজন্য সময় লাগবে।’

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের উপকূলীয় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত নয়। বর্তমানে যে বাঁধগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়মিত জোয়ার-ভাটা প্রতিরোধে সক্ষম। বাংলাদেশে উপকূলীয় বাঁধের পরিধি পাঁচ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে অন্তত ৫০০ কিলোমিটারজুড়ে পাঁচ থেকে ছয় মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার, যাতে শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ করা যায়।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নদীভাঙনের বিষয়ে আমরা উপজেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসনসহ সবাইকে জানিয়েছি; কিন্তু ভাঙন ঠেকাতে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এমনটা আমি কখনোই দেখিনি। আমার মনে হয় না, এই এলাকারও কেউ কখনো দেখেছে। আমরা সরকারের কাছে চাল-ডালের মতো কোনো সাহায্য চাই না। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি, নদীভাঙন বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসীন জানান, বন্যকবলিত এলাকার মানুষকে ত্রাণ সহায়তার বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা একেবারে প্রত্যন্ত চরাঞ্চল পর্যন্ত ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। 

পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, ‘এবার বর্ষা মৌসুমের শুরু অর্থাৎ গত এপ্রিল মাস থেকে বন্যা পরিস্থিতি নজরদারি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কোথাও বন্যা হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যাতে কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫