
করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপাকে পড়েছেন দরিদ্র মানুষ। এমনিতেই তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। তার ওপর অসুস্থতার জন্য ওষুধ, পথ্য কিনতে চলে যাচ্ছে প্রান্তিক মানুষের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। ফলে অর্থ খরচ করে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করাতে আসছেন না অনেকেই। এটা যে শুধু ২০০ টাকা খরচ করলেই হয়ে যায়, তা নয়। পরীক্ষা করাতে আসা-যাওয়ার যাতায়াত খরচ তো আছেই, এর সঙ্গে রয়েছে সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট। এসব কারণে মানুষ আগের মতো উৎসাহী হয়ে পরীক্ষা করাতে আসছেন না।
সারাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষজ্ঞরা সেই মার্চ মাস থেকেই নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে মাত্র দুই হাজার করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট ছিল। তখনই বিশেষজ্ঞরা দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে দৈনিক ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার সুপারিশ করেছিলেন। তা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
আবার করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফি নির্ধারণের পর পরীক্ষা বাড়েনি বরং কমে গেছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দৈনিক ৩০ হাজার করোনাভাইরাস পরীক্ষার টার্গেট নির্ধারণ করেছে।’
এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে নমুনা পরীক্ষার কিট সংকট। ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষার টার্গেটের কথা বলা হলেও এখনো তা ১৭ থেকে ১৮ হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। পরীক্ষা ফি ধার্য করার পর তা ১৪ থকে ১৫ হাজারে নেমে এসেছে। ফি নির্ধারণের পর বাড়ছে না নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা। করোনাভাইরাস পরীক্ষার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দরিদ্র দেশের (আফগানিস্তান) চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি এবং করোনাভাইরাস বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় এখনো আমাদের টেস্টের সংখ্যা কম। পরীক্ষা বাড়ানোর জন্য আমরা পরামর্শ দিয়েছি, যাতে আরটি পিসিআর টেস্টের পাশাপাশি র্যাপিড অ্যান্টিজেনের মতো পরীক্ষাও চালু করা হয়। র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট এর মধ্যেই দুটি জায়গায় শুরু হয়েছে, এটি আরও বাড়ানো হবে। যারা পরীক্ষা করাতে চাইবেন, সবাই যেন করাতে পারেন। কেউ যেন ফেরত না যান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকদের অনেককে টেস্টের জন্য ছোটাছুটি করতে হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। চিকিৎসকদের এ অবস্থা হলে অন্য পেশাজীবী বা অন্য শ্রেণিগোষ্ঠীর মানুষের যে অসুবিধা হচ্ছে, তা স্পষ্টই বোঝা যায়।’
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘যাদের করোনাভাইরাসের পরীক্ষা দরকার, তাদের সবার টেস্ট করতে হবে, তাদের সবার নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। পজিটিভ হয়েছে এমন সবার পরীক্ষার ফল ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা করা গেলে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি করা যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত কিট সংকটের কারণেই নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেন কিট অপচয় না হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও বুথে করোনাভাইরাস পরীক্ষার উদ্দেশ্যে সন্দেহজনক আক্রান্তদের লম্বা লাইন থাকলেও গত কয়েক দিন ধরে সবার নমুনা নেওয়া হচ্ছে না। নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন, নমুনা সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর একেবারে প্রয়োজন ছাড়া, উপসর্গহীন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা হচ্ছে না। আগে যেসব প্রতিষ্ঠান তিনশ’র মতো নমুনা সংগ্রহ করত, এখন নমুনা সংগ্রহ দেড়শ’ কিংবা তার কাছাকাছি নামিয়ে এনেছে।
অপচয় রোধ করার জন্য হাসপাতালে ভর্তি শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদেরও টানা তিন দিন ওষুধ না খেয়ে জ্বর-শ্বাসকষ্টসহ করোনাভাইরাসের অনান্য উপসর্গ না থাকলে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা না করেই। আইইডিসিআর’র মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘জ্বর অথবা শ্বাসকষ্ট টানা তিন দিন না থাকলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার দরকার হবে না। তবে তাকে বাসায় কঠোরভাবে ১৪ দিনের আইসোলেশনে থাকতে হবে। উপসর্গহীনভাবে ১০ দিন থাকলে তাকে করোনাভাইরাস মুক্ত বলে ধরে নেওয়া হবে। এর জন্য তার পুনরায় নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না।’
পরীক্ষার ফি নির্ধারণের ব্যাপারে সরকারের একটি ভাষ্যও রয়েছে। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে। আরটি পিসিআর একটি দামি পরীক্ষা। বিনা পয়সায় করা যায় বলে এর অপচয় হচ্ছিল। প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই বেশি করে টেস্ট করিয়ে নিচ্ছিলেন। সাধারণ মানুষও লাইনে দাঁড়িয়েই একাধিকবার টেস্ট করিয়ে নিচ্ছিলেন। এটা রোধ করার জন্যই মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, ‘একটি করোনাভাইরাসের টেস্ট করাতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এত দামি একটি পরীক্ষার কিট অপচয় হোক এটি দেশবাসীও চাইবে না। সে কারণে পরীক্ষা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর একটি সুফল এখনি পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে পরীক্ষার সংখ্যা কিছুটা কমে গেছে। মনে হচ্ছে, এখন যারা পরীক্ষা করাতে আসছেন প্রকৃতই তাদের পরীক্ষা করা দরকার।’
তবে এ যুক্তিকে ‘খোঁড়া যুক্তি’ বলে মনে করছেন অনেকেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম মোজাহেরুল হক বলেন, ‘এ যুক্তি মানতে পারছি না। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ অথবা রাজধানীর প্রান্তিক আয়ের মানুষ একাধিকবার টেস্ট করাতে আসেন না। তারা পরীক্ষা করাতে আসেন বাঁচার তাগিদে, প্রকৃতই অসুস্থ হয়ে। একাধিবার টেস্ট করাতে আসেন প্রভাবশালীরা। ফি নির্ধারণ করা হলেও প্রভাবশালীরা আসবেনই। কারণ তাদের কাছে ২০০ অথবা ৫০০ টাকা কোনো ব্যাপার না। ফলে যে উদ্দেশ্যে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে তাতে দরিদ্র, প্রান্তিক আয়ের মানুষই করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নিরুৎসাহিত হবেন। কারণ তাদের কাছে ২০০ টাকা অনেক টাকা। এ টাকা দিয়ে তাদের পরিবারের জন্য একদিনের খাবার খরচ হয়ে যায়। বাধ্য না হলে তারা ২০০ টাকা দিয়ে পরীক্ষা করাতে আসবেন না। এ কারণে প্রকারান্তরে করোনাভাইরাস পরীক্ষা কমে যাবে।’
দেশে দৈনিক যে ১৫ থেকে ১৭ হাজারের মতো পরীক্ষা করা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। পরীক্ষা করে যে রোগী শনাক্তের কথা বলা হচ্ছে, এর মধ্যে নতুন রোগী যেমন রয়েছে, তেমনি আগে যারা আক্রান্ত হয়ে এখনো সুস্থ হননি, পুনরায় পজিটিভ হয়েছেন, সেই রোগীরাও রয়েছে। অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘যেভাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্টিং হচ্ছে, সেটি সঠিক হচ্ছে না। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে তা আনতে হবে। আগের আক্রান্ত যারা এখনো পজিটিভ রয়ে গেছেন, তাদের নাম বাদ দিয়ে রিপোর্টিং করতে হবে। তাহলে আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা উঠে আসবে।’