Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

কেমন ভার্চুয়াল আদালত চাই

Icon

অ্যাডভোকেট জয়নাল আবদিন

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২০, ০২:০১

কেমন ভার্চুয়াল আদালত চাই

প্রতীকী ছবি

‘ভার্চুয়াল’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ প্রকাশ্যে বা নামত স্বীকৃত না হলেও কার্যত, কার্যসিদ্ধ, যথাযথ। শব্দটির সাথে আমাদের জানাশোনা আগে থেকেই ছিল। তবে ভার্চুয়াল আদালতের সাথে পরিচয় অতি অল্প দিনের। 

বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারির থাবায় সবকিছু বন্ধ হয়ে পড়ে। আমাদের দেশেও গত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। তখন সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য, আদালতের বিচার-আচার সব কিছুই কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। উন্নত বিশ্বে ভার্চুয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার করে অফিস-আদালতের কাজকর্ম পরিচালনা করার ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে ভার্চুয়াল আদালতের ধারণা একেবারেই নবতর সংযোজন। 

তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিচারক, আইনজীবী, বিচার প্রার্থী ও অভিযুক্তের কেউই সশরীরে উপস্থিত না হয়েও আদালতের কর্মকাণ্ড, বিচার নিস্পত্তির প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়াই হলো- ভার্চুয়াল কোর্ট বা সরল বাংলায় বলা যায়- তথ্য প্রযুক্তির আদালত। 

গত ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় ভার্চুয়াল আদালত সংক্রান্ত অধ্যাদেশের অনুমোদনের পর খুবই সীমিত আকারে ভার্চুয়াল আদালতের কাজ চলছে। ভার্চুয়াল আদালতে শুনানির মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার অভিযুক্ত জামিন পেয়েছেন। ইতিমধ্যে ৮ জুলাই এ অধ্যাদেশটি সংসদে আইন হিসেবে পাস হয়। আইনের শিরোনাম হচ্ছে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার আইন-২০২০’। বিশেষ সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আদালতের কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যেই এই আইন প্রণয়ন করা হয়। 

বিদ্যমান বাস্তবতায় ভার্চুয়াল আদালতের সুযোগ-সুবিধা বিচার সংশ্লিষ্ট সবাই গ্রহণ করতে পারছেন না। এর কারণ- প্রথমত, তথ্য প্রযুক্তির এ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সসহ অপরাপর ডিজিটাল পদ্ধতি সম্পর্কিত জ্ঞান আইনজীবী, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি বিজ্ঞ বিচারকদের বেশিরভাগেরই নেই। 

দ্বিতীয়ত, দেশে ৩৬ লাখ মামলা যেখানে বিচারাধীন, সেখানে নগণ্যসংখ্যক ভার্চুয়াল আদালত দিয়ে বিচার ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করাও অসম্ভব। ভার্চুয়াল আদালতে শুধু ফৌজদারী মামলার জামিন শুনানির ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেওয়ানী বিচারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত হচ্ছে। 

প্রযুক্তির দুনিয়ায় ভার্চুয়াল আদালতের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালতের গুরুত্ব যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি ভবিষ্যতে বর্তমানের মতো বিশেষ পরিস্থিতি উদ্ভব হলে, সে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের ব্যবস্থাও নিতে হবে। 

বর্তমান বাস্তবতা হলো- আদালত সংশ্লিষ্ট সবাই আইনজীবী, বিচারক, আদালতের স্টাফরা যদি ভিডিও কনফারেন্সসহ অন্যান্য ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতেন, তাহলে বিচার ব্যবস্থার ওপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হতো না। মামলা বিচারের দীর্ঘ সূত্রতা, বিচার প্রার্থী মানুষের আহাজারি দিন দিন প্রশমিত না হয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার কারণে মামলা-মোকদ্দমায় যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে, তার রেশ কাটতে কত সময় লাগবে সেটি বলা দুরূহ। 

ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল প্রক্রিয়ার ভেতরে প্রবেশ করলে টের পাওয়া যায় আমাদের প্রযুক্তি জ্ঞান কত সীমিত। আদালতের সমন জারি, সাক্ষী উপস্থাপন, সাক্ষ্য গ্রহণ ও সওয়াল-জবাবের শতাব্দি প্রাচীন পদ্ধতি আজও অটুট। ‘ডিজিটাল-ডিজিটাল’ বলে আমরা উদ্বেলিত হতে পারি, এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বিচার প্রার্থী মানুষ আদালতের বারান্দায় লেফট-রাইট করতে করতে ভিটে-মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। 

সংসদের পাস হওয়া এ নতুন আইন উপস্থাপনের আগে সংশ্লিষ্টদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করলে আরো বেশি প্রয়োগিক বা ফলপ্রসূ করার সুযোগ সৃষ্টি হতো। শুধু বিশেষ সময় বা বিশেষ পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়া বিচারিক অচলাবস্থা নিরসনের গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে না। আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু বিশেষ সময়ে নয়, স্বাভাবিক সময়ে ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে উপনেবেশিক শাসনামলে প্রণীত আইনের অনেক জটিল ও কুটিল বিচারিক পদ্ধতি সহজ ও সাশ্রয়ী করা যায়। ভার্চুয়াল আদালত আইনে সেই সব অন্তর্ভুক্ত করার অবারিত সুযোগ ছিল; কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সেদিকে না হেঁটে আপদকালীন টোটকা চিকিৎসা দিয়ে ক্ষত সারাতে চাইছেন। 

বিচার ব্যবস্থা আধুনিকায়নের কত মুখরোচক গল্প আমরা শুনেছি বছরের পর বছর। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে কারাগার থেকে আদালতে সকাল-বিকাল আসামি হাজির ও কারাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির যে লম্বা লাইন পড়ে, আমাদের ডিজিটাল ব্যবস্থা এত দিনেও তার সমাধান দিতে পারল না; অথবা সংশ্লিষ্টরা ইচ্ছে করেই এসব আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। 

মোবাইলে ক্লিক করলে পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর অপর প্রান্তে মুহূর্তে পাওয়া যায়, অথচ মামলা মোকদ্দমার সমন বা নোটিস জারির জন্য আদালতের জারি কারককে বাদী বা আসামির ডেরায় সশরীরে তশরিফ আনতে হয়। সমন নোটিস জারির প্রক্রিয়ায় মামলা ঘুরপাক খায় বছরের পর বছর। আর আমাদের দেওয়ানি-ফৌজদারি উভয় বিচার ব্যবস্থাই নানা পাকে বাঁধা পড়ে বিচারপ্রার্থী মানুষকে চরকার মতো ঘুরাচ্ছে বছরের পর বছর। ভার্চুয়াল আদালত নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম এ প্রসঙ্গে বলেন, আকস্মিকভাবে ভার্চুয়াল আদালত চালু এক ধরনের স্ট্যান্টবাজি। এই ধরনের একটি ব্যবস্থার জন্য মোটেই কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। ভার্চুয়াল আদালতের সব কিছু প্রযুক্তি নির্ভর করা হয়নি। ভিডিও কনফারেন্সে শুনানি করে নকল পাওয়ার জন্য রেকর্ড রুমে যেতে হবে- এই ব্যবস্থার দরকার কি ছিল? ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রস্তুত না করে, খামোখা দেশের মানুষকে চমক দেয়ায় জন্য ‘গাড়ি কেনার আগে ঘোড়া জুড়ে দেয়ার’ অবস্থা ছাড়া আর কিছু নয়। আইনজীবী, আদালতের স্টাফ, বিজ্ঞ বিচারক ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনায় দক্ষ নন। শত বছরের বেশি সময় আমরা যে ব্যবস্থায় অভ্যস্ত, সেখান থেকে নতুন একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যে রকম প্রস্তুতি নেয়া দরকার ছিল, তার কিছুই না করে এই ব্যবস্থা চালু একেবারে অবিবেচনা প্রসূত! এমনিতে আমাদের বিচার ব্যবস্থা দুর্নীতি-অনিয়মের আখড়া। ভার্চুয়াল ব্যবস্থা দুর্নীতির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ব্যবস্থায় বিচারপ্রার্থীদের উপকারের চেয়ে অপকার হচ্ছে। কিছু অভিযুক্তের জামিন হচ্ছে; কিন্তু ভবিষ্যতে এসব মামলা পরিচালনায় নানা জটিলতার সৃষ্টি করবে।”

ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল ভার্চুয়াল আদালত ব্যবস্থাকে সরাসরি নাকচ না করে সময়ের প্রয়োজনে এ ব্যবস্থা বিচারপ্রার্থীদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, বিচারব্যবস্থা আধুনিকায়নের এটিও এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। প্রযুক্তির সাথে সাথে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। আইনজীবী, বিচারক ও আদালতের স্টাফদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনায় দক্ষ করা গেলে এ ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দেয়া সম্ভব। যা বিচারব্যবস্থার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যক্তি ও ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সরাসরি যোগাযোগের যে প্রাচীন পদ্ধতি, সেটি থেকে বের হতে পারলে বিচার নিস্পত্তিতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হবে, যা থেকে সবাই উপকৃত হবো।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫