Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বাঁচার লড়াইয়ে পেশা বদল

Icon

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২০, ২৩:১৯

বাঁচার লড়াইয়ে পেশা বদল

প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের যাঁতাকলে পিষ্ট মানবতা। মাসের পর মাস রোজগার বন্ধ। এখনো কভিড-১৯ সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি আমরা সাক্ষী থাকছি এক আশ্চর্য মানবিক সংকটের। 

ভাইরাসের আক্রমণে কতজন প্রাণ হারালেন, সে হিসাব রাখা হচ্ছে প্রতিদিনই; কিন্তু ক্ষুধায় বা দারিদ্র্যের ছোবলে দেশের দুর্বলতম জনগোষ্ঠীকে কী মূল্য চুকাতে হচ্ছে, তার কোনো পাকা হিসাব কষা হয়নি এখনো। 

এতদিন রাজনীতিকদের মুখে উন্নয়নের গল্প শুনে দিবাস্বপ্নে বিভোর হলেও, জেগে দেখা গেল সবই ছিল হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার খেলা। অঘোষিত লকডাউনের দুয়েক দিনেই শ্রমজীবী মানুষ পৌঁছল বিপন্নতার চূড়ান্ত সীমায়। হারাতে হলো কাজ, হাতে টাকা নেই, পাতে নেই অন্ন- জীবনের হিসাব টেনে শূন্য খাতায় রাতের আঁধারেই ছাড়তে হলো লাল-নীল বাতির শহর। নিজেকে কাপড়ে আড়াল করে ডুকরে কাঁদে শিক্ষিত মধ্যবিত্তও। জুটছে না নতুন কোনো কাজ, আবার পারছেন না ত্রাণের লাইনে গিয়েও দাঁড়াতে। তাই পেটের টানে লজ্জার আবরণ সরিয়ে পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। 

কোথাও আবার মুখোশের আড়ালে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ডিম বিক্রি করছে মেধাবী শিক্ষার্থী। শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সংস্থান করতে যে মানুষকে এতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়; সেটাই অতি দুঃখের, অতি লজ্জার।

জাতির মেরুদণ্ডে ফাটল

গৃহশিক্ষকতার পেশা ছেড়ে মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার বিক্রি শুরু করেছেন রাজধানীর শাহজাদপুরের মাইদুল ইসলামের মতো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবকরা। মাস্টার্স শেষ করে বরিশাল থেকে মাইদুল ঢাকায় এসেছিলেন চাকরির খোঁজে; কিন্তু ধরতে পারেননি সেই সোনার হরিণ। তাই কয়েকজনকে নিয়ে খিলবাড়ীরটেকে একটি কোচিং সেন্টার খুলেছিলেন। প্রায় ২০-২৫ জন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে চলছিল তার কোচিং সেন্টার। তাদের পড়িয়ে সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভালোভাবেই; কিন্তু করোনাভাইরাস আটকে দিল সেই যাত্রা। কষ্টেশিষ্টে কিছুদিন চলার পর, সংসার আর চলছে না। জীবন বাঁচাতে তাই বদলে ফেললেন পেশা। শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি এখন সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রেতা। অল্প হলেও, আয় তো হচ্ছে। তা দিয়েই কোনোরকমে চলছে সংসার।

করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি সংকটে শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। চার মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় বেতন পাচ্ছেন না শিক্ষকরা। তাই জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে টিকে থাকতে পেশা বদল করছেন কেউ কেউ। কল্যাণপুরের খান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক নাজমুল আজাদ। বেতন বন্ধ থাকায় চলছিল না সংসার। তাই জীবন বাঁচাতে ফল বেচতে নেমেছেন পথে। 

আজাদ বলেন, ‘ফল বিক্রির এই আয়োজনটা নিছক আনন্দ কিংবা বাড়তি রোজগারের আশায় নয়। পরিস্থিতি বাধ্য করেছে। স্কুলের আয় না থাকায় বেতন পাচ্ছি না। করোনাভাইরাসের কারণে এখন তো আর কারও বাসায় যাওয়া যায় না। তাই টিউশনিও বন্ধ। এখন কী আর করব বলেন, সংসারটা তো চালাতে হবে!’ 

শুধু নাজমুল আজদই নন, দেশের অন্তত সাড়ে সাত হাজার নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষকের অবস্থাই এখন এমন। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) বলছে, সংকটে থাকা শিক্ষকদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আপাতত স্থগিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের আগে যে হচ্ছে না, এটি মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তো বেঁচে থাকতে হবে। বাঁচাতে হবে সংসারটাকেও। তাই বাবার সাথে হকারি করছেন রাজধানীর একটি কলেজের শিক্ষার্থী সিয়াম হোসেইন। বাবা রবিউল পেশায় রাজমিস্ত্রি। কাজ নেই, তাই আপাতত ভ্যানে করে সবজি নিয়ে বসছেন। তার থেকে কিছুটা দূরে ডিমের খাঁচি নিয়ে বসে সিয়াম। মাস্কে ঢাকা তার লাজুক মুখটা। অভাবের সংসারে দিন-রাত বই-খাতায় মাথা গুঁজে বসে থাকা যে সম্ভব নয়, তা মেনে নিয়েছে সে।

থমকে যাওয়া হকারদের রুটি-রুজি

ট্রেনে ট্রেনে খেলনা, বই, কলম, চকলেট, ফল, বাদাম, চানাচুর, চা-বিস্কুট, রুটি কিংবা রুমাল বিক্রি করেই কোনোরকমে টেনে নিয়ে যান দেহ-চাকা। তাদেরই একজন গফরগাঁওয়ের এরশাদুল হক। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটের ট্রেনে চানাচুর বিক্রি করতেন। করোনাভাইরাসে লকডাউন শুরুর পর থেকেই বেকার হয়ে পড়েন। সংসারে আরো পাঁচ সদস্য রয়েছেন। তাই পথ বদলে মাথায় তুলে নেন মাছের হাঁড়ি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করেন। সন্ধ্যায় কোনো এক লোকাল ধরে আবার বাড়ি ফিরে যান। 

মাছ বিক্রির ফাঁকেই সম্প্রতি এরশাদ বলেন, ‘হেই ছুডুবেলাতইন (ছোটবেলা) ট্রেইনে চানাচুর বিক্রি করি। অহন দেশে রুগডা (কভিড-১৯) আওনের ফরই ট্রেইন বন্ধ হইয়া যায়। কাম ছাড়া আর কতদিনই বইয়া থাহন যায় কন? আমি ছাড়াও ঘরে আরো পাঁচটা পেড (পরিবারের সদস্য) আছে। খাওন তো লাগব। হেইর লাইগ্যাই মাছ লইয়া নামছি। বেইনবেলা (সকালে) ঢাহায় আই, বেইচা-টেইচা হাইঞ্জালা (সন্ধ্যায়) ট্রেইন ধইরা বাড়ি যাইগা।’ 

কথার প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘ট্রেইন চালু হইলেও, বেচাবিক্রি নাই। আমাগোর লগের কয়েকজন আগের কামই করে; কিন্তু মানুষ অহন আর বাইরের খাওন কিনে না।’

সোনার সংসার ছাই

তাঁতীবাজারের শ্রী শ্রী জগন্নাথ জিঁউ মন্দির লাগোয়া খুব পুরনো বাড়ির একতলায় একটা খুপরি ঘরে বসে সোনার আংটিতে ঠুকঠুক করে হাতুড়ি মারছিলেন মানিক মালাকার। হলুদ বাল্বটা সিলিং থেকে নেমে এসেছে সামনে পেতে রাখা জলচৌকির ওপর। বাকি ঘরটায় সেই আলো-আঁধারির খেলা। কিন্তু মানিকের মনে এক বিন্দু আশার আলো নেই। কেবলই অন্ধকার। 

‘কাজ-টাজ কেমন চলছে দাদা?’ প্রশ্ন শুনেই মাথা তুলে এই প্রৌঢ় বললেন, ‘লকডাউনের পর কয়েক দিন হলো কারখানা খুলেছে। কোনো কাজ নেই। স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৮০০ থেকে হাজার টাকা রোজগার হয় যেখানে, সেখানে এখন বউনিটাও হচ্ছে না অনেক সময়।’ হাতের আংটিটায় আলতো করে দু’বার হাতুড়ি মেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মানিক, নিজে থেকেই বলতে লাগলেন, ‘পরিচিতদের বলে রেখেছি, হাজার দশেকের মধ্যে যে কোনো একটা কাজ পেলে জানাতে। সেটা সিকিউরিটি গার্ডেরই হোক বা দোকানের হেল্পারই হোক। কারণ এ পেশায় আপাতত ভবিষ্যৎ দেখছি না। মানুষ বেঁচে থাকার যুদ্ধ করবে নাকি অলঙ্কার পরবে। এর মধ্যে আবার বেড়ে গেছে সোনার দাম।’  

তারার মেলায় ছোবল

করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত চলচ্চিত্র ও নাটক শিল্পও। জীবনের মায়ায় শুটিংয়ের সাহস পাচ্ছেন না তারকারা। পেশা বদলাচ্ছেন তারাও। মডেলিং দিয়ে মিডিয়ায় এলেও পরে নাটক-সিনেমায় ব্যস্ত হন চিত্রনায়ক নিরব। করোনাকালে কাজ নেই, ভাবছেন অন্য পেশার কথা। এই বন্দি সময়ে তিনি অনলাইন ব্যবসার বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। 

নিরব বলেন, ‘প্রায় তিন বছর আগে এ ধরনের ব্যবসার চিন্তা মাথায় আসে; কিন্তু অভিনয় ব্যস্ততার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তখন কাজটি শুরু করতে পারিনি। লকডাউনের সময় থেকেই আবার বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা সাজাচ্ছি। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরেই অনলাইন ব্যবসা শুরু করব। এর পর লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করেই ঠিক করব পরবর্তী কর্মপন্থা।’

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশে নিয়মিত বেতন ও মজুরি পেয়ে কাজ করেন এ রকম মানুষ সংখ্যায় খুবই কম, যথাযথ মজুরি আরো কম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই স্বনিয়োজিত; অনিশ্চিত, অনিয়মিত পেশাই বাংলাদেশের প্রধান জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার অবলম্বন। তাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে প্রতিদিনের হাড়ভাঙা কাজের ওপর। করোনাভাইরাসের আক্রমণে এই কোটি কোটি মানুষ এখন বেকার ও দিশেহারা। আমরা দেখতে পাচ্ছি, করোনাভাইরাস ছাড়াই তাদের জীবন ক্ষুধা ও অনিশ্চয়তায় বিপন্ন। অধিকাংশের এমন কোনো সঞ্চয়ও নেই, যা তাদের অনিশ্চিত সময় পার হতে সাহায্য করবে। বরং তাদের আরো ঋণগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের দৃষ্টিতে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই! অথচ কয়েকটি গোষ্ঠীর কাছ থেকে জনগণের লুণ্ঠিত সম্পদের কিয়দংশ উদ্ধার করলেই এ বিপদ থেকে জনগণকে উদ্ধার করা সম্ভব। কারণ গত ১০ বছরে বিদেশে পাচার হয়েছে কমপক্ষে সাত লাখ কোটি টাকা। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে ১০টি গ্রুপের হাতেই আছে ৩০ হাজার কোটিরও বেশি। আমরা হিসাব করে দেখেছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপদগ্রস্তদের রক্ষায় ৭০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকার একটি প্যাকেজ বরাদ্দ প্রয়োজন। সরকার এই বরাদ্দ ঘোষণা করে তা বাস্তবায়নের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করলে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন খুবই সহজ হতো। স্বচ্ছতার সাথে কাজ করলে বহু সামাজিক শক্তি এতে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে রাজি থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি; কিন্তু কে শুনে কার কথা!’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫