-5f1d747114966-5f1d98b80c966.jpg)
আবারো বন্যার কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। ফলে ২৫ জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী, প্রাণহানিও ঘটেছে। শুধু জামালপুরেই বন্যায় ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এবছর দফায় দফায় বন্যা হচ্ছে। এখন পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। দেশের ৩০ শতাংশ এলাকা বন্যায় ভুগছে। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, দোকান-বাজার, শিক্ষালয়, আশ্রয়কেন্দ্র, উপসনালয়, সড়ক-মহাসড়ক, ছোট বড় বাঁধ। মানুষের কৃষি-গবাদিপশু-হাঁস মুরগী-মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত। বন্যা কবলিত দেশের বিশাল এলাকার। খাবারের সন্ধানে, পানযোগ্য পানির জন্য, একটু আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ দিশাহীন।
এখন পর্যন্ত বৃহত্তর রংপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জামালপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ পুরো বন্যাকবলিত ও ঢাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত। ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুরও আক্রান্ত হচ্ছে। আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। বন্যার বিস্তৃতি, স্থায়ীত্ব আরো বাড়বে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বন্যায় প্লাবিত অঞ্চল থেকে পানি সরে যেতে এখন সময় লাগে, ধীর গতিতে পানি যায় বঙ্গোপসাগরে। ফলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে, ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা হয় বেশি। বন্যা অবশ্যই নতুন কিছু নয়। বৃষ্টি-অতিবৃষ্টি প্রাকৃতিক। তবে চলমান-দৃশ্যমান বন্যা মূলত এক ধরনের ব্যাপক আকারের জলাবদ্ধতা, যা মানুষের সৃষ্টি। এ পরিস্থিতির উৎসের সন্ধান করলে দেখা যায়, উপনিবেশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সরকার ব্যবস্থাপনা কর্তৃক কথিত প্রয়োজনে অপরিণামদর্শী পরিকল্পনায় রেলসড়ক, সড়ক, বাঁধ, জলাধার, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়ে নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলে বন্যা ও নদ-নদীকেন্দ্রিক ক্ষয়ক্ষতি ক্রমান্বয়ে আজকের রূপ ধারণ করেছে।
বাংলাদেশে বন্যার বর্তমান ধরন-কার্যকারণ নিয়ে গবেষণাপত্রের তথ্যে উঠে এসেছে- চীন, ভারত, নেপাল কর্তৃক গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা অববাহিকায় প্রায় ৫০০টি ব্যারেজ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। যেগুলোর জন্য পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ হিমালয় থেকে চীনের তিব্বত, ভারতের অরুনাচল হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার, চীন তিব্বতের ব্রহ্মপুত্রে তার দেশের বৃহত্তম ‘জঙ্গমু’ বাঁধ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জলাধার নির্মাণ করেছে। এছাড়াও চীন হুবেই প্রদেশে ইয়াংজি নদীতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ‘থ্রি জর্জেস’ হাইড্রো ইলেকট্রিক বাঁধ নির্মাণ করে বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করেছে।
উজান দেশের ওইসব বাঁধ প্রকল্প এখনকার জলাবদ্ধতা রূপী বন্যার অন্যতম কারণ। যদিও চীনের ‘থ্রি জর্জেস’ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও কম্বোডিয়া আপত্তি জানিয়ে রেখেছে। এসব প্রকল্পের কারণে চীন এখন বেশি বন্যাক্রান্ত। পূর্বাভাস, চীনে এবার ৪০ কোটি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর ভারতের মালদহ-মুর্শিদাবাদের গঙ্গায় বহুল আলোচিত ‘ফারাক্কা’ বাঁধ, উত্তরাখণ্ডের ভাগীরথী নদীর ‘তেহেরি’ বাঁধ, হিমাচল-পাঞ্জাবের ‘শতদ্রু’ বাঁধ- ওড়িশার ‘হীরাকুঁদ’ ও ‘ইন্দাবতী’ বাঁধ এখন বাংলাদেশ এমনকি ভারতের জন্যও সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
ভারতের আসাম, মেঘালয়, বিহারে এবছর যে অতিবৃষ্টি ও বন্যা দেখা দিয়েছে- এর জন্য ভারতকে হয়তো ফারাক্কার বাংলাদেশমুখী স্বপ্নদুয়ারগুলো খুলে দিতে হবে, যা বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ হয়ে দেখা দিবে। ভারতে এরই মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি নাজুক, শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে বন্যার কারণে, অবস্থার আরো অবনতির আশঙ্ক করা হচ্ছে।
এদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য নয়; উন্নয়নের ভ্রান্ত ধারণা, কর্মকৌশল, ব্যাপক শিল্পায়ন, বিস্তৃত নগরায়ন, বিদ্যুতের আকাশচুম্বী চাহিদার যোগান ইত্যাদি বহুমুখী কথিত প্রয়োজনে এ অঞ্চলে যত্রতত্র বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, জলাধার, জলবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বহু প্রকল্প-স্থাপনা নির্মিত হয়েছে ও হচ্ছে। এরূপ উন্নয়ন চাহিদার ডামাডোলের প্রকল্পের কারণে দেশগুলো নিজেরাই এখন বন্যা-দুর্যোগে বিপদগ্রস্ত। এর ফলে বাংলাদেশের অবস্থা বেশি শোচনীয়। বিগত ৪/৫ দশকে আত্রাই, পুনর্ভবাসহ দেশের অসংখ্য নদী ক্ষীণকায় বা প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ নদনদী-জলাশয় প্রায় নিশ্চিহ্ন। শুধু কুড়িগ্রামেই ৫০ এর বেশি আর রংপুরে দেড় শতাধিক নদ-নদী উধাও! দুধকুমার ছাড়া ব্রহ্মপুত্র-তিস্তার কোনো শাখা নদীর অস্তিত্বই নেই। গঙ্গাধর, গিরাই, হলহলিয়াসহ বহু শাখা নদীর নামই ভুলে গেছে মানুষ।
অনেক শাখা নদী বাঁধ দিয়ে দীঘি বানিয়ে লিজ দেয়া হয়েছে। বহু জলাশয়-বিলগুলোর পানি আসা যাওয়ার পথ বন্ধ করে বাড়িঘর, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, নানারকম স্থাপনা গড়ে উঠেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৈরি তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র ঘিরে বিশাল ত্রিমুখী বাঁধ এখন মানুষের গলার ফাঁস, এর পানি নিষ্কাশনের যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় অচল। কুড়িগ্রামের উলিপুর- চিলমারীর মানুষ এই বাঁধ ভাঙ্গার দাবি তুলছেন। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের শতাব্দীকালব্যাপী চলমান যুদ্ধসম কার্যকলাপ এখন এসে আত্মঘাতী হয়ে গেছে।
এদিকে জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ৩০ বছরে এশিয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল এমনিতেই এই মহাদেশের সবচেয়ে পানিবহুল আর পৃথিবীর অন্যতম পানিবহুল এলাকা। এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় ১ হাজার মিলিমিটার। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ২০১২ সালে করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভারী বর্ষণ বাড়তে থাকলে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের ১৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ উপকূলীয় বা অভ্যন্তরীণ বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে। ১৯৫০-২০১৭ সাল পর্যন্ত উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের ২২ লাখ মানুষ বন্যায় প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে শুধু ১৯৫৯ সালের বন্যায় চীনে ২০ লাখ মানুষ মারা যায়।
বৈশ্বিক আবহাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব সবারই জানা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ভারী বর্ষণ ঘটে চলেছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে বন্যার সৃষ্টি হয়। বার্ষিক বৃষ্টিদিনের সংখ্যা কমে যায়, কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টিপাতের ঘটনা বেড়ে যায়। দেখা যায়, অনেক দিন ধরে বৃষ্টি না হয় না, কিন্তু হঠাৎ এক দিনে বা এক ঘণ্টায় অতিমাত্রায় বৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শ্রাবণ মাসে এখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির বদলে মুষলধারে বৃষ্টি হয়।
তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ভারতীয় গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুপ্রবাহে তারতম্য দেখা দিচ্ছে। বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। মৌসুমি বায়ুর আগমন বিলম্বিত হওয়া ছাড়াও অল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তা অনিয়ন্ত্রিত বন্যায় রূপ নিচ্ছে। রবার্ট কয়েনরাড তাঁর ন্যাচারাল ডিজাস্টার অ্যান্ড হাউ উই কোপ গ্রন্থে দাবি করেছেন যে ২০ শতকের বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে বন্যার মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭০-এর দশক থেকে বন্যার পৌনঃপুনিকতা বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ সরকারের ২০০৯ সালের জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, একটি স্বাভাবিক বছরে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ডুবে যায়। প্রতি চার-পাঁচ বছরে একটি প্রবল বন্যা আসে, যা দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবিয়ে দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তন শুধু অতিবৃষ্টির মাধ্যমেই বন্যার সৃষ্টি করছে, এমন নয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দ্রুত ভোগান্তিতে পড়তে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে বাংলাদেশ। জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে মানুষ প্রায় প্রতিবছর বানভাসি হচ্ছে। সায়েন্টিফিক আমেরিকান সাময়িকীতে রবার্ট গ্লেনন বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে লিখেছেন যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা তিন ফুট বাড়লে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ ভূমি ডুবে যাবে এবং তিন কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। তবে বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ দাবি করেন যে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পাঁচ-ছয় ফুট বাড়তে পারে এবং তাতে সম্ভবত পাঁচ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।
এ ছাড়া হিমালয়ের হিমবাহ ও স্নোপ্যাক গলে গিয়ে নদীগুলোকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে, যা বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। ভারতের পানি নীতিও বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে ব্যাপক আকারে নদীর গতিপথ বদলে সেচকাজে পানি ব্যবহার করছে ভারত। কিন্তু বন্যা শুরু হলে বাঁধ ছেড়ে দিয়ে বন্যার তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষও বন্যাকবলিত হচ্ছে। তাই এখনকার বন্যা কতটা প্রাকৃতিক তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।