
মেট্রোরেল প্রকল্প। ফাইল ছবি
এমনিতেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে গতিশীলতা কম। যে প্রকল্পের কাজ তিন বছরে সমাপ্ত হওয়ার কথা, সেটি চলছে প্রকল্পভেদে ৭ থেকে ১১ বছর ধরে। তার ওপর কারোনাভাইরাসের আবির্ভাব সেটিকে থমকে দিয়েছে। ফলে দেশের ছোট-বড়-মেগা প্রকল্পগুলো বেশ ঝিমিয়ে পড়েছে।
প্রতি বছরই শতাধিক প্রকল্প অনুমোদনের পর ঘুমিয়ে কাটায়। গত মার্চ থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্পের কাজ মাঠ পর্যায়ে বন্ধই রয়েছে। চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পকে।
উন্নয়ন কার্যক্রম যে থমকে পড়েছে, তার বাস্তব উদাহরণ গত অর্থবছর। ইতিহাসের সর্বনিম্ন ৮০.১৮ শতাংশ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এত কম এডিপি আর কোনো অর্থবছরেই দেখা যায়নি। এর আগে ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর সর্বনিম্ন ৮০.৬৬ শতাংশ ছিল এডিপি বাস্তবায়ন হার।
করোনাভাইরাসের কারণে গত অর্থবছর বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও ব্যয় হয়নি। পুরো চার মাস প্রকল্পগুলো বন্ধ রয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকা ছয় মেগা প্রকল্পে গত কয়েক বছরে ব্যয় হয়েছে ৮৯ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। যা প্রকল্পগুলোর মোট খরচের ৩৪.৬২ শতাংশ। তবে এখন পর্যন্ত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প ছাড়া বাকি প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি তথ্যানুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) বরাদ্দের অনেক কম অর্থ খরচ হয়েছে মে মাস পর্যন্ত। ওই সময়ে প্রকল্পগুলোর জন্য ৩০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫৬.৫২ শতাংশ, ১৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে গত অর্থবছরের ১১ মাসে কেবল মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে বরাদ্দের প্রায় শতভাগ অর্থ ব্যয় হয়েছে। আর দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল লাইন নির্মাণে ব্যয় করা গেছে ৮০ শতাংশ। বাকি চার প্রকল্পের ব্যয় ছিল অর্থবছরের বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক। অগ্রগতিও কাক্ষিত নয়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, ঘুমিয়ে বছর কাটানো ১২১ প্রকল্পের মধ্যে কিছু প্রকল্প ২০১৫, কিছু প্রকল্প ২০১৭ ও কিছু ২০১৮ সালে শুরু হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রোহিঙ্গা, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে, দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো উন্নয়নের প্রকল্পও আছে। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতি বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাগিদ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মেগা প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে বলা হয়েছে।
বলা হয়েছে- জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় করে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারের লক্ষ্য, প্রকল্পের কাজ দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করা। আর সেজন্য চলমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনাও প্রদান করা হয়েছে।
আগের অর্থবছরগুলোর তথ্যানুযায়ী, অনেক প্রকল্পই অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। প্রতি অর্থবছরই শতাধিক প্রকল্প ঘুমিয়ে কাটায়। পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগ, মাতারবাড়ী ১২শ’ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, কর্ণফুলী টানেল এবং দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছাকাছি ঘুমধুম সীমান্ত পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প সরকারের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্প। এগুলো বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ ৮ হাজার ৫৩৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
২০০৯ সালে ঘটনাবহুল পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প, ২০১০ সালে দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল লাইন নির্মাণ, ২০১২ সালে মেট্রোরেল, ২০১৪ সালে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, ২০১৬ সালে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ স্থাপন এবং একই বছর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও প্রকল্পের কাজ শুরু করার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। অথচ এখন পর্যন্ত এগুলোয় খরচ হয়েছে মাত্র ৮৯ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। এখানে গত অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ৩৪.৬২ শতাংশ অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশের সামান্য বেশি অর্থ খরচ হয়েছে।
বিশাল অর্থ ব্যয়ের প্রকল্পটি হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয়। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা। গত অর্থবছরের আরএডিতে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। আর মে মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে সাত হাজার ৮৭৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৩২৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি ২৫.০৪ শতাংশ। ১২টি ওয়ার্কিং ডকুমেন্টেশন প্যাকেজ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। প্রতিটির জন্য মাইলস্টোন অ্যাচিভমেন্ট সার্টিফিকেট সই হয়েছে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় বরাদ্দ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। লক্ষ্য ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল চার হাজার ১৫ কোটি টাকা। আর মে মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে দুই হাজার ৮৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের সূচনা থেকে ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ২৯৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৭৯.৫০ শতাংশ। মূল সেতু নির্মাণ কাজ হয়েছে ৮৭.৫০ শতাংশ। নদী শাসন কাজ ৭২ শতাংশ। তবে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়, প্রকল্পটি নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ নাও হতে পারে।
৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে মাতারবাড়ী ১২শ’ মেগাওয়াট আল্টা সুপার বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আরএডিপিতে বরাদ্দ করা তিন হাজার ২২৫ কোটি টাকার মধ্যে মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ২০১ কোটি টাকা। শুরু থেকে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় ধরে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু হয়েছে। লক্ষ্য আগামী ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করা। গত অর্থবছরের আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ২৯৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। মাত্র ২৯৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে গত মে পর্যন্ত। প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ২৪.৪৩ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি ৩০.৫২ শতাংশ।
২০১০ সালের জুলাই থেকে চলছে দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি। যার বাস্তবায়ন খরচ ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। সমাপ্ত করার লক্ষ্য ২০২২ সালের জুনের মধ্যে। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে এ পর্যন্ত চার হাজার ৮০৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সে হিসাবে ১০ বছরে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২৬.৬৫ শতাংশ। আর বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৩৯ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে ঋণ সংক্রান্ত জটিলতা ও ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা হওয়ার কারণে অগ্রগতি সন্তোষজনক হয়নি। সবশেষ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি আরো ধীর করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের ধাক্কায় সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে প্রকল্পগুলোর কোনোটিতেই বরাদ্দকৃত অর্থের অর্ধেকও খরচ হয়নি।
বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির অভিমত হলো, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতার ও সক্ষমতার অভাব রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও সঠিকভাবে তদারকি করে না, যার কারণে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কাজে অনেকটা ধীরগতি থাকে। প্রতি বছরই এডিপি পর্যালোচনার সময় একই সমস্যা দেখা যায়; কিন্তু কোনো উত্তরণ ঘটছে না।
দেশের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মন্তব্য হলো, ‘নতুন ভাবনার সময় এসেছে মেগা প্রকল্পসহ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে। করোনাভাইরাসের ধাক্কা থেকে উত্তরণের জন্য নতুন করে কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তা না হলে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে। ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়া হলো পুরনো সমস্যা। ব্যবস্থাপনায় সমস্যার কারণেই প্রকল্পে এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দাতাদের অনুমোদন, একনেকের অনুমোদন, অর্থ ছাড় সবই হয়েছে; কিন্তু প্রকল্প বসে আছে ঝিম মেরে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সময় লেগে যায়। আবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ হয়। এসব প্রকল্পের ভিন্নতা অনুযায়ী সমস্যাও ভিন্ন। কোনো ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা। সেজন্য বিমানবন্দর, নির্মাণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ একটি বড় সমস্যা। সিদ্ধান্ত ছিল- জমি অধিগ্রহণ যদি কোনো প্রকল্পে থাকে, তাহলে ওই সমস্যা সমাধান না হলে প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদন পাবে না। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করেই ডিপিপি একনেকে পাঠাতে হবে। অথচ এসব আর দেখা হচ্ছে না। তাড়াহুড়া করে প্রকল্প অনুমোদন নেয়া হয়। ফলে পরে জটিলতা দেখা দেয়। তখন তো অর্থ ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই।’