আইন বহির্ভূত হত্যা সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক

নিজস্ব প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১৭:৪৬

পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর বিচার বহির্ভূত হত্যা নিয়ে আবারো আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুক যুদ্ধের নামে এবং নিরাপত্তা হেফাজতে বিচার বহির্ভূত হত্যা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যে গত প্রায় দুই দশকে দেশে ৪ হাজারের বেশি মানুষ বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২০৭ জন ব্যক্তি বিনা বিচারে হত্যার শিকার হয়েছেন।
অধিকাংশ ঘটনার সাথে পুলিশ আর র্যাব সদস্যরা জড়িত থাকলেও যৌথবাহিনী, সেনাবাহিনী, বিজিবি, গোয়েন্দা পুলিশ, কোস্টগার্ড, আনসারসহ বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে প্রায় সবগুলো বাহিনীর বিরুদ্ধেই। গত বিশ বছরে ক্ষমতাসীন সব সরকারের আমলেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নিনা গোস্বামী গণমাধ্যমকে বলেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ কোনো সরকার নেয়নি। বাংলাদেশে একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে বিচার বহির্ভূত হত্যার। কোনো সময়ই আমরা এটার লাগাম টেনে ধরার সদিচ্ছা কখনোই দেখিনি। এটাকে বরং আমরা দেখি অন্য দেশে হচ্ছে, অন্যদেশে পুলিশ করছে এরকম বিচ্ছিন্ন দুএকটা উদাহরণ টেনে আনা হচ্ছে।
নিনা গোস্বামী বলেন, কিন্তু আমাদের দেশে এটা নিয়মিত হচ্ছে! শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে ২০১৮ সাল থেকে যেভাবে অভিযান হচ্ছে, বিচার বহির্ভূত হত্যা হয়েছে তাতে মাদক কি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে? প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাবে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতেই হবে। তা নাহলে কখনোই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কোনো একটা উদাহরণ দিয়ে কোনো দেশের উদাহরণ দিয়ে এটাকে জাস্টিফাই করার সুযোগ নাই।
বিচার বহির্ভূত হত্যার নতুন ধারার সূচনা হয় এ শতকের প্রথম দিকে বিএনপি সরকারের সময়। ২০০২ সালে 'অপারেশন ক্লিনহার্ট' নামের অভিযানে অনেকে বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এরপর র্যাব প্রতিষ্ঠার পর কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন বহু মানুষ। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যে বিএনপি সরকারের ২০০২-০৬ সালে মোট ১ হাজার ১৫৫ জন ব্যক্তি বিনা বিচার হত্যার শিকার হন।
এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭-০৮ এই দুই বছরে ৩৩৩ জন একইরকম হত্যাকাণ্ডের শিকার। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের এ পর্যন্ত অন্তত আড়াই হাজার মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
মানবাধিকার আইনজীবী সারা হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে ধারা চলছে এটি গভীর উদ্বেগের। যদি ধরেও নেই যে এ ধরনের একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে। যে পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী এ ধরনের ঘটনা ঘটাবেই তাহলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে সংস্কৃতি পাল্টানোর জন্যও কিন্তু নানারকম প্রক্রিয়া বা কলাকৌশল আছে।
তিনি বলেন, যেগুলো রাষ্ট্র নেয়। কিন্তু আমরা সেটা দেখিনি। এখন আশা করছি শেষে যে ঘটনা ঘটেছে (সিনহা হত্যা) এটা যদি শেষে পর্যন্ত একটা বিশেষ মুহূর্ত দাঁড় করায় আমাদের সমাজের জন্য যে এটার পর থেকে আর ঘটনা ঘটবে না। তবে আমি খুব আশা রাখছি না অবশ্যই!
মানবাধিকার কর্মীরা সবাই চান মেজর সিনহার ঘটনার পর এ সংস্কৃতি বন্ধ হোক। নিহত সিনহা রাশেদের মায়েরও দাবি আর কেউ যেন এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার না হন। আইএসপিআরও বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ আশ্বস্ত করেছে এটি শেষ ঘটনা এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু এই শেষ বলতে কি সব বিচার বহির্ভূত হত্যার শেষ বোঝাচ্ছে এ প্রশ্ন অনেকের।
নিনা গোস্বামী বলেন, একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটছে কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। এবার সিনহা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেজন্যই হয়তোবা এ বিষয়টা সামনে এসেছে বা সরকারের পক্ষ থেকে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু নিয়মিত যে সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে! সাধারণ মানুষও বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছে। সেটার উত্তর আমরা কার কাছে চাইবো? আইনতো একেকজনের জন্য একেকরকম হতে পারে না।
বিচার বহির্ভূত হত্যা সংস্কৃতি প্রসঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. শামসুল হক টুকু গণমাধ্যমকে বলেন, অযৌক্তিক কোনো হত্যা যেন না হয় সেটাই তারা চান। তিনিও আশা করেন যে সিনহার ঘটনাটা হবে এ ধরনের শেষ কোনো ঘটনা। কোনো হত্যাই তদন্তের ঊর্ধ্বে নয় উল্লেখ করে তার দাবি আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যার সমর্থন করে না।
তবে শামসুল হক টুকুর কথায় অপরাধ দমন এবং জননিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্র তাকে দিয়েছে। ব্রিটেন আমেরিকা ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশেও পুলিশের গুলীতে সন্ত্রাসীরা মারা যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, জানমালের নিরাপত্তা এবং দেশের আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্যে অপরাধীদের যে কৌশল সে কৌশলকে পরাজিত করবার জন্যে যা করা দরকার সেই মুহূর্তে সেটি তার করা দায়িত্ব। এটা রাষ্ট্র তাদের দায়িত্ব দিয়েছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
এদিকে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এতটাই স্বাভাবিক একটা ঘটনা হয়ে গেছে যে জাতীয় সংসদেও কথিত ক্রসফায়ারের সমর্থনে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। সংসদে সরকারি দল এমনকি বিরোধী দলের সদস্যরা ক্রসফায়ারের সমর্থনে বক্তব্য দিয়েছেন যার সমালোচনা হয়েছে।
বিএনপির সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, যখন দেখছে যে ভয়াবহ আকারে দেশে ধর্ষণ বা এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা সংঘটিত হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ সমস্ত অপরাধীদের যে আইনি শাস্তি বা পদক্ষেপ নেয়া দরকার তারা সে পদক্ষেপে থেকে দূরে থাকছে, সে কারণে অনেক সময় আমাদের মত ব্যক্তি বা আমাদের মতো জায়গা থেকে উদ্বেগের জায়গা থেকে বলেছি যে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ যেহেতু সরকারের ব্যর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র ব্যর্থ হচ্ছে সুতরাং এদেরকে চূড়ান্ত শাস্তি, সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
বিএনপি নেতা হারুনুর রশীদ মনে করেন রাষ্ট্র চাইলেই একমাত্র বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব। এখনই আজকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলে দিক যে কোনো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে চলবে না। একটাও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হবে না।
কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, কোনো যুক্তিতেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন বা বৈধতা দেয়ার সুযোগ নেই। আইনজীবী সারা হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমি ক্ষমতায় আমি সিদ্ধান্ত নেব যে কে খারাপ, আমি সিদ্ধান্ত নেব যে তার কী হবে-যখন এই পরিস্থিতিটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যেটা অনেকটা হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে, তখনতো দেখা যায় যে যাকে পছন্দ করে না তাকেই কিন্তু এই ক্রসফায়ারের মধ্যে ফেলা শুরু করবে এবং ঠিক এরকম পরিস্থিতি আমরা দেখছি।
মানবাধিকার কর্মীদের আরো অভিযোগ বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিছুক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রশ্রয় পেয়েছে। সর্বশেষ কক্সবাজারের মেজর সিনহা হত্যায় অভিযুক্ত একজন কর্মকর্তাও সর্বোচ্চ পুলিশ পদক পেয়েছেন যার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের সবগুলো ঘটনায় আসামি নিহত হয়েছেন বলে খবর হয়েছে।
ক্রসফায়ার-গুম যে আমাদের গণতন্ত্রের ভীত নড়বরে করে দিচ্ছে, এই উপলব্ধি বড়ই প্রয়োজন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এখন অনেক অভিজ্ঞ ক্রসফায়ার-গুম করার ক্ষেত্রে। এমন সময় আসবে যখন ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া একজন র্যাব-পুলিশ সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন উপায়ই থাকবে না। ইতিমধ্যেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাই এখনই এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।