Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ক্রসফায়ার কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২০, ০৯:০৯

ক্রসফায়ার কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা?

প্রতীকী ছবি

কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নামে সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরের হত্যাকাণ্ডকে সরকারের তরফে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ও তদন্ত টিমের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সেনাবাহিনীর আস্থা আছে, পুলিশ বাহিনীরও আস্থা আছে। আমরা আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটা জিনিস নিশ্চিত করতে চাই- যে ঘটনাটা ঘটেছে, এই ঘটনার সাথে যারা সম্পৃক্ত থাকবে, সেটার দায়দায়িত্ব কোনো প্রতিষ্ঠানের হতে পারে না।’

বিচ্ছিন্ন ঘটনা মানে যা কালেভদ্রে ঘটে, যার সাথে অন্যান্য ঘটনার মিল নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো- টেকনাফে যা ঘটলো, সেটি কোন অর্থে বিচ্ছিন্ন? পুলিশ কি এর আগে কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করেনি, বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করেনি? ক্রসফায়ারের ভয়কে কি অবৈধ অর্থ উপার্জনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারে পরিণত করেনি? 

তাহলে টেকনাফে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যার ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন হয় কী করে? কী করে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই ঘটনাকে একজন ব্যক্তির অপরাধ বলে দায় অস্বীকার করে? এটি কি তাদের পুরো সিস্টেমের অংশ নয়? ওসি প্রদীপ কি সেই সিস্টেমের বাইরের কেউ? তার মতো কর্মকর্তা কি দেশের আর কোনো থানায় নেই বা অতীতে ছিল না? 

পুলিশের গুলিতে একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তার নিহত হওয়ার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গত ৫ আগস্ট সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি ‘ক্রসফায়ার সংস্কৃতি’ বিকাশের উদাহরণ। 

টিআইবির বিবৃতিতে ওই ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিশ্চিতের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানানো হয়।

পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ক্রসফায়ারকে ‘এনজিওদের শব্দ’ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন হলো- অপরাধ দমনের জন্য ও অপরাধ দমনের নামে এ যাবত যত লোক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে, সেগুলো যদি ‘ক্রসফায়ার’ না হয়, তাহলে সেগুলো কী? ‘ক্রসফায়ার’ না বললে এগুলোকে সরাসরি হত্যাকাণ্ড বলতে হবে। পুলিশ কি সেটা মেনে নেবে?

প্রশ্ন উঠতে পারে, কিছু অতি সভ্য রাষ্ট্র বাদ দিলে অধিকাংশ দেশেই কোনো না কোনোভাবে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে, যাকে ওইসব রাষ্ট্র অপরাধ দমনের ‘কার্যকর কৌশল’ বলে মনে করে। বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে হয়তো এছাড়া বড় ধরনের অপরাধ দমন করাও কঠিন। কিন্তু বিনা বিচারে কাউকে গুলি করে মেরে ফেলা নৈতিক কারণেই সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা বিনা বিচারে কাউকে মেরে ফেলার অর্থই হলো প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। 

আইন ও প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার অজুহাতে বিনা বিচারে অপরাধীকে মেরে ফেলা হবে- এটি কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি হতে পারে না। বরং বিচারব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের দুর্বলতা ও আইনের ফাঁক গলিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে, এই অজুহাতে বিনা বিচারে মেরে ফেলার বৈধতা দেয়ার মানেই হলো- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে হত্যার লাইসেন্স দেয়া। 

যখন তারা বিনা বিচারে একশো অপরাধীকে মেরে ফেলে, তখন নিরপরাধ দশজনকে মেরে ফেলার বৈধতাও পেয়ে যায় এবং অনেক অপরাধীর মধ্যে কিছু নিরপরাধ লোক বিনা বিচারে হত্যার শিকার হলেও সাধারণ মানুষ ওই নিরপরাধ লোকদের হত্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না বা তুললেও সেই প্রশ্ন হালে পানি পায় না। তখন এই ব্যবস্থা থেকে নিরপরাধ লোকগুলোও যে ‘ভয়াবহ অপরাধী’ ছিল, অথবা মেরে না ফেললে তাদের যে প্রচলিত আইনে বিচার হতো না, সেটি প্রমাণের চেষ্টা করে। বিশেষ করে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে এ রকম ধারণাই দেয়া হয়। 

তবে সবসময় এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, বা সব ঘটনাকে মানুষ বিশ্বাস করে না বলে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন কিংবা মেজর (অব.) সিনহার হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্র নড়েচড়ে বসে। ক্রসফায়ার বা বিনা বিচারে হত্যার সমর্থকরাই তখন আবার এর বিপরীতে অবস্থান নেন। এ কারণেই বলা হয়, ১০ অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার চেয়ে একজন নিরপরাধ মানুষের শাস্তি হওয়া বেশি ক্ষতিকর।

জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি ও ধর্ষকদের প্রতিহত করতে একশ’ অপরাধীকে বিনা বিচারে হত্যা করার পর একজন নিরপরাধ লোকও যদি বিনা বিচারে এভাবে হত্যার শিকার হন, তাহলে ওই একশো অপরাধীকে মেরে ফেলাটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মানুষ তখন সন্দেহ করে- অপরাধী বলে যাদের মেরে ফেলা হয়েছে, তারা কি আসলেই অপরাধী ছিলেন? তাছাড়া আদালতে প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, ধর্ষক বলার সুযোগ নেই। 

গোয়েন্দারা অনেক সময় বড় বড় অপরাধের সন্ধান পান ও চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক তথ্য উদ্ঘাটন করেন। ওই প্রক্রিয়াতেই অনেককে কথিত অস্ত্র উদ্ধারের নামে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। যাদেরকে মারা হয়, ধরে নেওয়া যেতে পারে, তাদের অধিকাংশই অপরাধী ও প্রচলিত আইনে বিচার করতে গেলে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যেত না। ফলে তার মতো অন্য অপরাধীদের মনে ভয় ঢুকানো তথা পুরো চক্র ধ্বংস করার জন্য তাদের বিনা বিচারে মেরে ফেলা হলো। একটি সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে যা মোটেও কাক্সিক্ষত নয়। 

সবচেয়ে বড় কথা, অপরাধ দমনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এভাবে বিনা বিচারে হত্যার অনুমতি দেয়ার অর্থই হলো- এই সুযোগকে অসৎ কাজে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করা। সব সময় অপরাধীরাই যে নিহত হয়েছে বা হয় তা নয়, বরং টাকা-পয়সার লেনদেন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবেও ক্রসফায়ারকে ব্যবহার করা হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারাদেশে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সাথে শতাধিক কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮৭ জন। অথচ দেশের সংবিধান সব নাগরিকের আইনি সুরক্ষা পাওয়ার যে অধিকার দিয়েছে, তাতে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকলেই কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করার কোনো অধিকার দেয়া হয়নি। নিহতদের বেশ কয়েকজন কোনোভাবেই ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন না, এমন তথ্য-প্রমাণ নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রচারমাধ্যমের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি চাঁদা দেয়া না হলে ‘ক্রসফায়ারে দেয়ার’ মতো অভিযোগও কম নয়।

অতীতের যেকোনো ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের সাথে টেকনাফে মেজর সিনহার খুন হওয়ার ঘটনার সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেই পার্থক্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রতিক্রিয়া ও রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ায়ও। নিহত মেজরের পরিবারকে ফোন করে সান্ত্বনা ও ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এই ঘটনায় এরইমধ্যে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে। 

ফলে অতীতের ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের আলোকে মেজর (অব.) সিনহার নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে মিলিয়ে দেখা এবং সামগ্রিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চরিত্র, বিশেষ করে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে টেকনাফে আসলে কী হয়, সেটিও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। 

কার্যত প্রতিটি ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধই প্রকারান্তরে গুলি করে হত্যা করা; কিন্তু এবারের ঘটনাটি অধিকতর আলোচনায় আসার কারণ- হত্যার শিকার ব্যক্তির পরিচয়। অর্থাৎ, একজন চিহ্নিত বা সন্দেহভাজন অপরাধী এমনকি একজন নিরীহ মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হলেও সেটি আলোচনায় থাকবে না, বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় হবে না, যদি না তার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়। 

অর্থাৎ, গুলিতে নিহত হওয়ার পর কারও পরিবার ন্যায়বিচার পাবে কিনা, সেটা নির্ভর করছে আপনার পরিচয়ের ওপর; আইন বা বিচারব্যবস্থার ওপরে নয়। সুতরাং এর কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সবকিছু একটি বৃহৎ সিস্টেমের অংশ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫