Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

পদ্মাসেতুর পিলারের মাটি ক্ষয় নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য

Icon

কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২০, ২১:১৮

 পদ্মাসেতুর পিলারের মাটি ক্ষয় নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য

পদ্মা সেতু নিয়ে একটি কুচক্রী মহল বিভ্রান্ত ছড়াতে নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়ে উঠেছে। এরই অংশ হিসেবে ‘পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে’ এমন মন্তব্য করা হচ্ছে আবার কিছু গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে সংবাদ প্রচারও করছে ওই মহলটি।

এছাড়া ‘পদ্মা নদী অত্যন্ত খরস্রোতা হওয়ায় খুঁটির গোড়ার মাটি সরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে’ এমন তথ্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের দ্বিতীয় খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যের সঙ্গে একমত হয়নি পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম।

উল্টো তিনি বলেছেন, সরকার এত টাকা খরচ করছে, আর আইএমইডির সংশ্লিষ্টরা ম্যানেজমেন্ট থেকে পাস করে বা কেউ হয়তো ইতিহাসে পাস করে বলে দিলো ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা তো ইতিহাসে পাস করি নাই। ম্যানেজমেন্টের ছাত্রও না।

শফিকুল ইসলাম আরো বলেন, আমাদের ডিজাইন ১০০ বছরের। এই ব্রিজের স্থায়িত্ব ১০০ বছরের। সেভাবে কাজ হচ্ছে। কোথাকার কে কী বলল, সেটা আমাদের জানার দরকার নাই।

অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মতিন বলেন, পদ্মা সেতুর নকশা ওই ভাবেই করা হয়েছে। স্কোয়ারিং হলেও কিছু হবে না। প্রথমত, স্কোয়ারিং মনিটরিং করতে হবে। কতটুকু স্কোয়ারিং হলো প্রতি বছর তা মনিটরিং করতে হবে। দেখতে হবে, প্রত্যাশিত স্কোয়ারিংয়ের চেয়ে বেশি চলে গেছে কিনা। চলে গেলে তার মেজার নিতে হবে। মেজার তো অনেক ধরনের হতে পারে। পাথর ফেলেও করা যায়। অবশ্য পাথর থাকে না। চলে যায়। ড্রেজিং করে, একটু নিয়ম করে ফেলতে হবে আর কী।

তিনি আরো বলেন, প্রতিবেদনটা যারা তৈরি করেছে, তারা কি টেকনিক্যাল পার্সন, সেটা জানা দরকার। কারণ বিষয়টা নন-টেকনিক্যাল পার্সোনালরা দেখলে হবে না। আইএমইডি এটা উল্লেখ করলে তার মেজার নিতে হবে তো। স্কয়ারের জন্য মেজার নিতে হবে। এটা টেকনিক্যালি দেখতে হবে।

এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক প্যানেল বিশেষজ্ঞদের প্রধান অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছেন, ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’ নামের এই বিরল পদ্ধতিতেই বসানো হয়েছে পদ্মাসেতুর অনেক খুঁটি, যার ওপর বসেছে সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি। ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’য়ের মতো বিরল পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে পদ্মাসেতুর কাজ, সে বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন পদ্মাসেতুর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রধান।

তিনি জানান, এরকম পদ্ধতি ব্যবহারের দৃষ্টান্ত বিশ্বে খুব একটা নেই। এ প্রক্রিয়ায় ওপর থেকে পাইলের সঙ্গে স্টিলের পাইপের ছিদ্র দিয়ে কেমিক্যাল নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির শক্তি বাড়ানো হয়েছে। এরপর ওই মাটিতে নির্মাণ করা হয়েছে খুঁটি। জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পদ্মাসেতু নির্মাণে সবচেয়ে বড় জটিলতা তৈরি হয়েছিল সেতুর পাইল ড্রাইভিং নিয়ে। সেতু নির্মাণের আগে নদীর তলদেশের মাটি সম্পর্কে যে ধারণা করা হয়েছিল, কাজ শুরুর পর সেই ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনি।

সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পদ্মা নদীর স্রোত যেমন বৈচিত্র্যময়, ঠিক নদীর তলদেশেও রয়েছে নানা বৈচিত্র্যময় মাটির গঠন। তাই ১৪টি খুঁটির জিডাইন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এতে ১৪টি খুঁটির ৮৪টি পাইলের নতুন নকশা পরিবর্তন কাজ শেষে চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে নতুন ডিজাইন পাওয়া যায়। নির্ভরযোগ্য প্রকৌশলীরা জানিয়েছে, ১৪টির মধ্যে ৪টি খুঁটির নিচের মাটির নরম অংশ নিয়ে চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। সেগুলোর গভীরতা ১২৯ মিটারের পরিবর্তে ১৩৫ মিটার করতে গেলে পাইলের টিউব পরিবর্তন করতে হবে। এসব বিবেচনায় গভীরতা বৃদ্ধির বিকল্প হিসেবে প্রতিটি পিলারে ৬টির পরিবর্তে ৭টি পাইল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর মাওয়া প্রান্তের ৬ ও ৭ নম্বর পিলারে প্রায় দুই বছর আগেই ৩টি করে বোটম পাইল রাখা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১৭ সালের গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী প্যানেল বিশেষজ্ঞদের সরেজমিন সভায় এ সংক্রান্ত বিষয়ে বিদেশী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান “কাউই” ও “রেল্ডেল” বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর ১৫ সেপ্টেম্বর প্যানেল বিশেষজ্ঞদের পুরো টিম নির্মাণাধীন সেতুর কার্যক্রম সরেজিমন পরিদর্শন করে। পরদিন সরেজমিন সভার শেষ দিন ১৬ সেপ্টেম্বর মাওয়া প্রান্তে ১৪টি পিয়ার স্থাপন সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেন এবং বিশ্বের আমাজান নদীর পর পানি প্রবাহের দিক দিয়ে বাংলাদেশের খরস্রোতা পদ্মা নদী দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। পাশাপাশি খরস্রোতা পদ্মা নদীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জটি সফল হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প নির্মাণ কাজে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্যানেল বিশেষজ্ঞদের তিন দিনব্যাপী সরেজমিন সভাটি নানা কারণেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ওই সভায় প্যানেল বিশেষজ্ঞদের দেয়া প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনায় পদ্মা সেতুর গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জটি সফলের দিকে এগিয়ে যেতে সম্ভব হয়। ওই সভায় পদ্মা সেতুর প্যানেল বিশেষজ্ঞদের প্রধান অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের আব্দুল আউয়াল, জাপানের ইসিয়ারা ও ফুজিনো, কানাডার অস্টেন ফিল্ট, নেদারল্যান্ডের কারবাজালসহ প্যানেল বিশেষজ্ঞসহ দেশী-বিদেশী ১১ জন বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন।

অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, মাটির এই স্তরে পাইলের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬টি থেকে ৭টি করা হয়। মাঝখানে ভার্টিকাল আরেকটি পাইল বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিশেষজ্ঞরা। এরপরেও এই স্তরের মাটি দুর্বল পাওয়া যাওয়ায় ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’ পদ্ধতিতে নদীর তলদেশে মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে তারপর পাইল ড্রাইভিং করা হয়। পাইল ড্রাইভিংয়ের সময় তার পাশে কয়েকটি স্টিলের চ্যানেল দিয়ে বিশেষ কেমিক্যাল সরবরাহ করা হয়, যা আশপাশের মাটিকে শক্তিশালী করে। এমন পদ্ধতির প্রয়োগ বাংলাদেশে এই প্রথম। গোটা বিশ্বেও এই পদ্ধতি প্রয়োগের নজির খুব একটা নেই।

তিনি বলেন, এই পদ্ধতি ব্যবহারের পর আমরা সন্তুষ্ট হই। ট্রেন বা যানবাহনের চাপ বেশি হলে অথবা ভূমিকম্প হলে সেতুর আর সমস্যা হবে না। এছাড়া নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এই মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানান জামিলুর রেজা।

তিনি আরো বলেন, সেতুর নিচ দিয়ে পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে রিভার ট্রেনিং করতে হয়েছে। সেজন্য বেশি সময় লেগেছে। নদী শাসন করতে লাখ লাখ টন পাথর (জিও ব্যাগ) ফেলা হয়েছে। এটাও অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিলো।

পদ্মাসেতু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’ প্রক্রিয়ায় পদ্মাসেতুর মোট ১১টি খুঁটি গড়ে তোলা হয়েছে। ৩২ নম্বর খুঁটিও রয়েছে এর মধ্যে। এই ৩২ নম্বর খুঁটি ও পাশের ৩৩ নম্বর খুঁটির ওপরই বসানো হয়েছে সেতুর ২১তম স্প্যান।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫