শোকাবহ আগস্ট
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যশোরের কয়েক নেতার স্মৃতিচারণ

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২০, ১৩:৪০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ইতিহাসের মহানায়ক বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যশোরের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই দেখেছেন খুব কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে আসার সুযোগও হয়েছিল কারো কারো।
মহান এই নেতার স্নেহধন্য তৎকালীন ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুকে রেখেছেন তাদের মনের মণিকোঠায়। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার রাজেক আহমেদ, তৎকালীন যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুল হুদা ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক অশোক রায় বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারা বলেন, যশোরে অসংখ্যবার এসেছেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার অনেকেআগে যশোরে এসে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে (আলী মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলায়) রাত্রিযাপন করেছেন তিনি। শহীদ মসিয়ূর রহমানের বাড়িতে, ওয়াপদা রেস্টহাউজে ও যশোর সার্কিট হাউসে অনেকবার রাত্রিযাপন করেছেন বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতা।
বঙ্গবন্ধু বাইসাইকেলে চড়ে ঘুরেছেন যশোরের গ্রাম গ্রামান্তরে, মানুষের দুঃখ কষ্টের খোঁজ নিয়েছেন। অসুস্থ দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে দেখতে জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছেন। বর্তমান তাজ হোটেলের পিছনে তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয় উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। টাউন হলে, টাউন হল ময়দানে ও যশোর স্টেডিয়ামে বক্তব্য রেখেছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু যখনই যশোরে এসেছেন একটু জানাজানিতে হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে রাস্তায়। ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যশোরে আসেন। এদিন উদ্বোধন করেন পুরাতন বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বিজয়স্তম্ভ ও পৌর পার্কের স্মৃতিফলক। সেদিন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সেই সময়কার ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাজেক আহমেদ।
তিনি এই মহাপুরুষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেকবারই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। তিনি বলেন, স্বাধীনতার আগে ও পরে খুলনায় প্রোগ্রাম থাকলে বঙ্গবন্ধু বিমানে চড়ে যশোর হয়ে যেতেন। এসময় হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে আমিও উপস্থিত হতাম সেখানে। আমার পরিচিত এক রিক্সাচালক (নাম মনে নেই), বড়ি গোপালগঞ্জ, ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিল বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখবার। একদিন তার কথা মতো যশোর বিমানবন্দরে নিয়ে গেলাম। সেই রিক্সাচালককে বঙ্গবন্ধুর সামনে নিয়ে বললাম বঙ্গবন্ধু এ আপনাকে দেখতে এখানে এসেছে। ও আপনার দেশের লোক, এসময় বঙ্গবন্ধু রাজেক আহমেদের পিঠে আদর করেই একটা চড় দিয়ে বলেন, তুই কোন দেশের?
রাজেক আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে ছবিতে যেমন দেখা যায় বাস্তবে তিনি ছিলেন আরো আকর্ষণীয়। তার সামনে দাঁড়ালে মনে হতো অনেক আগে থেকেই সে সম্পর্ক, অনেক আপনজন। তার কাছ থেকে সরতে ইচ্ছে করতো না।
রাজেক আহমেদ আরেকদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কিছুটা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, একবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ভবনে গিয়েছি তার সাথে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতেই আমার ছিপছিপে শরীর দেখে বঙ্গবন্ধু বুকে হাত বুলিয়ে বলেন তোর অবস্থা এমন কেন? শরীরটা খারাপ নাকি ? সাথে সাথে তোফায়েল আহমেদকে (সেসময়ে বঙ্গবন্ধুর এপিএস) ডেকে তিনি বলেন এই দেখ আমার সোনার ছেলে ওর হাড্ডি বেরিয়ে গেছে, ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। এসময় অশ্রুসজল হয়ে পড়েন রাজেক আহমেদ। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে অন্যদেশের চক্রান্তে এদেশের কিছু মানুষ হত্যা করেছে।
বঙ্গবন্ধুর আরেক স্নেহধন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম । ৬৯, ৭০-এর যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এই নেতা। রবিউল আলমকে ‘রবি’ নামে ডাকতেন বঙ্গবন্ধু। ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকাকালে অসংখ্যবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে গিয়েছেন রবিউল আলম। মহান এ নেতার সাথে রয়েছে তার অনেক স্মৃতি।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রবিউল বলেন, যশোরের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের বাদে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন ছাত্রনেতার সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাত হয়। একবার ঢাকা থেকে যশোরে ফেরার আগে রবিউল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। সেখানে প্রবেশ করেই দেখতে পেলেন বঙ্গবন্ধু বাড়ির বারান্দায় অন্য জেলা থেকে আসা আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলাপরত। রবিউলকে দেখেই বঙ্গবন্ধু বললেন, রবি তুই কখন এসেছিস? কেমন আছিস? বঙ্গবন্ধুর কাছে এগিয়ে গেলেন রবি, বললেন, যশোরে চলে যাচ্ছি। শরীরটা ভালো না। আর তাছাড়া ঢাকাতে এখন আমার কাজ নেই।
তিনি বলেন, এমন সময় সেখানে আসলেন এক বিদেশি মেহমান। তার সাথে পরিচয় নেই রবিউল আলমের। বঙ্গবন্ধু সেই মেহমানকে ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। আলাপ শেষে বেরিয়ে গেলেন ওই বিদেশি মেহমান। বঙ্গবন্ধু সেখান থেকেই ডাক দিয়ে রবিকে নিয়ে গেলেন উপরতলায়। খুব স্বাভাবিক ও নির্ভয়ে ভিতরে গেলেন রবি। বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন, ডাক্তার দেখিয়েছিস? রবি বললেন, না। যশোর গিয়ে ডাক্তার দেখাবো। বঙ্গবন্ধু রবিকে জিজ্ঞাসা করলো তোর মুখটা শুকনো কেন। উত্তরে রবি বলেন, মায়ের শরীরটা ভালো না। বঙ্গবন্ধু রবিকে বলেন সবার আগে মা, মাকে দেখভাল করার পাশাপাশি রাজনীতি। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু একটু গোপনে রবির হাতে গুঁজে দিলেন একশ টাকা। টাকা পেয়ে ভীষন খুশি রবিউল বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসলেন যশোরে।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা অশোক রায়েরও সুযোগ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে যাওয়ার। তিনি নিজেকে এজন্যে ধন্য মনে করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকে এবং উপহার দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে। বঙ্গবন্ধু তাকে দিয়েছিলেন একশ টাকা। ১৯৬৯ সালের ঘটনা এটি। তবে দিনক্ষণ জানা যায়নি। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেলে বঙ্গবন্ধুকে যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সংবর্ধনা দিয়েছিল। টাউন হলে এ সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধুকে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া হয় ‘রূপার খেঁজুর গাছ’। ছাত্রলীগ ওইদিন সন্ধ্যায় ওয়াপদা রেস্ট হাউসে পৃথক একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সে অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া হয় অশোক রায়ের আঁকা দু’টি ছবি, একটি বঙ্গবন্ধুর, অপরটি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। বঙ্গবন্ধু নিজের ছবি দেখে অবাক বিষ্ময়ে বলে ওঠেন, কে এঁকেছে? কে করেছে এ ছবি? তখন সাধারণ নেতাকর্মীদের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন অশোক রায়। সহকর্মীরা তাকে চ্যাংদোলা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দেয়। তাকে জড়িয়ে ধরেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু। বেশ প্রশংসা করেন অশোক রায়ের। বলেন, ‘রিক্ত আমি সিক্ত আমি/ দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা/ তোকে দিলাম তাই।’ এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু নিজ পকেট থেকে দু’টি জিন্নাহ মার্কা ৫০ টাকার নোট তার হাতে ধরিয়ে দেন। অশোক ভীষণ লজ্জায় টাকা নিতে চাইলেন না। বঙ্গবন্ধু তাকে জোর করে ওই টাকা ধরিয়ে দেন। আর এ থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে বেশ পরিচিত হয়ে পড়েন তৎকালীন এ ছাত্রনেতা। এরপর যশোরে যখনই এসেছেন বঙ্গবন্ধু এক নজর দেখেই কাছে ডেকে নিয়েছেন অশোক রায়কে।
১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। তৎকালীন যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সামসুল হুদা দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সাথে। এর মাত্র দু’দিন আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সামসুল হুদা। কুমিল্লাতে তার আদি বাড়ি। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেখা করতে গেলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সেক্রেটারি তোফায়েল আহমেদ তাকে পাঠিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর চিফ সেক্রেটারি রুহুল কুদ্দুসের কাছে। বঙ্গবন্ধু তখন রেস্ট রুমে অবস্থান করছেন। ইন্টারকমে বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয় যশোরের ছাত্রলীগ সভাপতি সামসু আপনার সাথে দেখা করবেন। ভিতরে যাওয়ার অনুমতি পান সামসু। বঙ্গবন্ধু তখন দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর রাখা মুড়ি খাচ্ছেন।
সামসুকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন কেমন আছিস, আয়, মুড়ি নে। মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট তিনি ছিলেন মহান এই নেতার একান্ত সান্নিধ্যে। এক সময় মুড়ি নিতে গেলে সামসুর হাতের আংটি দেখে বঙ্গবন্ধু জানতে চান, তোর হাতে রিং কেনরে? সামসু বলেন, হঠাৎ করে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, মা-বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কিছুটা অনুযোগ করে ধমক দিলেন সামসুকে, ‘এখনি বিয়ে করলি কেন? দল করবে কে? এখনো অনেক কাজ বাকি।’ এমনি দু’এক কথার পর জিজ্ঞাসা করলেন, বৌমা কোথায়? সামসু বললেন, বাড়িতে রেখে এসেছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, বিয়ে করে কেউ কি বৌ দূরে রাখে? বৌ-এর জন্যে কি কিনেছিস? সামসু নিচু স্বরে উত্তর দিলেন, কিছুই কিনিনি, আমি বেকার। হঠাৎ করে বিয়ে। এর আগে আমি মেয়েকে দেখিনি। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তার কোমরে গুঁজে দেন ১০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, এই টাকা শুধুমাত্র বৌমার জন্যে এক টাকাও তুই নিবি না। বঙ্গবন্ধু আরো দেড় হাজার টাকা দেন সামসুকে।
বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহমেদকে ডেকে পাঠান। তিনি সামসুকে বলেন, তুই কিছু বলবি না চুপ করে থাকবি। তোফায়েল আহমেদ আসলে তাকে বলেন, খবর শুনেছিস; সামসু বিয়ে করেছে। শোন, ও এখন বেকার। আমার কাছে কোন টাকা নেই। আমাকে ১০ হাজার টাকা ধার দে। তোফায়েল বলেন, ৫ হাজারের বেশি দিতে পারবো না। বঙ্গবন্ধু বলেন, তাই দে। এরপর কিছুক্ষণ জেলার রাজনীতি নিয়ে কথা হয় সামসু আর বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। শেষে তোফায়েলের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়ে চলে আসেন সামসুল হুদা।