
বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নেমে এলে প্রায় ৫০ ক্যাম্পবাসীকে আটক করা হয়।
ঢাকার মোহাম্মদপুরসহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা এদেশে নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলেও, তারা অনেক নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি নাগরিক হিসেবে তাদের পাসপোর্ট করারও সুবিধা নেই।
এর মধ্যে গত শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে বিদ্যুতের দাবিতে ক্যাম্পবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় অন্তত ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ক্যাম্পবাসী অনেকের নামে মামলা হয়েছে। এতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নিতে কাজ করা সংগঠন দ্য স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বলেন, ‘মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের বিদ্যুৎ সংযোগ এখানকার মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত ছিল; কিন্তু গত এক মাস আগে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এরপর থেকে প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে ছয়টি ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে অন্য পাঁচটি ক্যাম্পে সারাদিন বিদ্যুৎ থাকলেও জেনেভা ক্যাম্পে বিদ্যুৎ থাকে না। এর প্রতিবাদ করায় পুলিশ ক্যাম্পবাসীর ওপর আক্রমণ করে। ৮-১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। ৫২ জনের নামে মামলা দিয়েছে। ৫ হাজার মানুষকে অজ্ঞাত আসামি করেছে। সংঘর্ষের পর থেকে পুলিশ ক্যাম্পের সামনে অবস্থান করছে। এতে এখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।’
শওকত আলী বলেন, শুরু থেকে বিহারিদের বিদ্যুৎ বিল ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে পরিশোধ করা হয়। কিন্তু ভোটাধিকার দেওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে ডিপিডিসি আমাদের কাছে বিদ্যুৎ বিল চাইছে। অথচ আটকেপড়া পাকিস্তানিরা এদেশে নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলেও অনেক নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আয়ের কোনো উৎস না থাকায় বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সক্ষমতা নেই তাদের। এ ছাড়া বিহারিরা ভোটাধিকার পাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সময় অতিবাহিত করছেন। এখনো কোনো নাগরিক সুবিধা পাননি তারা।’
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার আনিসুর রহমান জানান, বিহারিদের সঙ্গে সংঘর্ষে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। সংঘর্ষের পর থেকে পুলিশ সদস্যরা মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের সামনে অবস্থান করছেন। আনিসুর রহমান আরও বলেন, ২০১৮ সাল থেকে তাদের বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার কথা বলেছে ডিপিডিসি। তাদের নোটিশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা বিল দেয়নি। এটা ডিপিডিসির ব্যাপার। কিন্তু গত শনিবার তারা রাস্তায় এসে প্রতিবাদ করায় পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়।
সরেজমিনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় জেনেভা ক্যাম্পে দীর্ঘ সময় অবস্থানকালে দেখা যায়, ছোট ছোট বস্তি ঘরে তাদের বসবাস। পানির অপর্যাপ্ততা, শৌচাগার ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সংকটসহ নানা সমস্যার মধ্যে তারা বসবাস করছেন। কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়- তাদের নিদারুন কষ্টের কাহিনী এবং পাকিস্তান সরকারের অঙ্গীকার ভঙ্গের বেদনার কথা। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে থাকা সরু গলি দিয়ে ভেতরে এগোতেই দেখা যায় একটি কক্ষের ভেতর একইসঙ্গে শোয়া, বসা, খাওয়া এবং রান্নার আয়োজন চলছে। সামনে এগোতেই ক্যাম্পের লোকজন এগিয়ে এসে বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের ক্ষোভের কথা বলতে শুরু করেন।
সোহেল নামে একজন বলেন, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বসবাস করলেও, বিহারি হওয়ার কারণে নানারকম বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। ভোটাধিকার পাওয়া সত্ত্বেও জীবন চলার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি বলেও জানান তিনি। স্কুল-কলেজে বিহারি ক্যাম্পের ঠিকানা দিলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করা হয় না। পড়াশোনার সুযোগ না পাওয়ায় চাকরি করতে পারি না। আয় রোজগারের পথও খুঁজে পাই না। এর মধ্যে সরকার দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ বিল দিলেও এখন আমাদের কাছে বিল চাই ডিপিডিসি। অথচ ক্যাম্পবাসীর আগের থেকে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
শফিক নামে আরেকজন বলেন, ‘পাসপোর্ট বানাতে দেয় না। নাগরিক সুবিধা বলতে কিছুই নেই আমাদের। এর মধ্যে ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের মধ্যে বসবাস করা যায় না। এসব লোকজন দেশের নাগরিক অনেক সুবিধা পান না বলে দাবি করে আসছেন বহুদিন। এ জন্য তারা নাগরিক হিসেবে কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ, স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, শিক্ষার সুযোগ, বিদেশে কর্মসংস্থান ও উচ্চশিক্ষার জন্য পাসপোর্ট করার অধিকারসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আসছে।’
ক্যাম্পবাসীদের অভিযোগ, এক রিটের প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশনায় ২০০৮ সালে ভোটের অধিকার পেলেও আর কোনো মৌলিক অধিকার তারা পাচ্ছেন না। পাসপোর্ট করতে গেলে তাদেরকে জানানো হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা নেই। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া মানেই দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া নয়। এ আটকে পড়া পাকিস্তানিদের কোনো স্ট্যাটাস এখনো নির্ধারিত হয়নি। এ কারণে তাদেরকে পাসপোর্ট দেওয়া যাচ্ছে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংবিধানের ১২২ (২) ধারা অনুসারে, ‘১৮ বছর বয়সী বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। একজন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া মানে সংবিধান অনুসারে তিনি দেশের সম্পূর্ণ নাগরিক।’
জানা যায়, ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত বাংলাদেশ-ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশে আটকেপড়া কয়েক লাখ উর্দুভাষী বিহারী, যারা পাকিস্তানে ফেরত যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, পাকিস্তান তাদের ফেরত নেবে বলে অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান তাদের ফেরত নেয়নি। ১৯৭২ সালে এবং এরপরের কিছুকাল রেডক্রসসহ কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নানা চেষ্টা-তদবির করলেও পাকিস্তান তাতে সাড়া দেয়নি। আবার বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক উদ্যোগেও কোনো সাড়া মেলেনি।
এই আটকেপড়া পাকিস্তানিদের স্থান হয় দেশের ঢাকা, রংপুর, সৈয়দপুরসহ প্রায় ১৭টি জেলার বিভিন্ন ক্যাম্প এবং এলাকায়। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ১৯৭১ সালের পরে জন্মগ্রহণকারীদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার এবং ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপনের পরিস্থিতি এতটুকুও বদলায়নি।