সাক্ষরতা অভিযান
সই আঁকতে জানলেই শিক্ষিত!

কে এম ওবায়দুল্লাহ
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:১৬
‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।’ দিগ্বিজয়ী নেপোলিয়ন বোনাপার্টের এই একটি উক্তিই দেশ গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
নীতিনিষ্ঠ সুস্থ সমাজ গড়ার পাশাপাশি উন্নয়নকে অর্থবহ করতে এর কোনো বিকল্প নেই। একজন শিক্ষিত মানুষই কেবল জানেন তার সামাজিক-রাজনৈতিক মৌলিক অধিকার কী কী ও কীভাবে তা রক্ষা করা সম্ভব। জবাবদিহির শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতেও চাই শিক্ষা।
তবে দেশি-বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠানের হিসাব-নিকাশে সাক্ষরতাকে শিক্ষার বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেই আমরা বেশ খুশি! আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে হিসাব করতেও বসে যাই- বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান। আগের বছরের তুলনায় এক কি দুই ধাপ এগোলেই পরিতৃপ্তির ঢেকুর। অথচ কাগজে-কলমে যাদের স্বাক্ষর বলে দাবি করা হচ্ছে, তাদের সিংহভাগেরই এখনো সেই টিপসই-ই ভরসা! অনেকে আবার নিজের নামটুকু কোনোরকমে লিখতে পারলেও, অ আ ক খ যেন কেবলই ছবি। অর্থাৎ অক্ষর পড়ার ক্ষেত্রে তারা ‘চোখ থাকিতেও অন্ধ’।
এক সময় কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে স্বাক্ষর বলা হতো; কিন্তু বর্তমানে এর জন্য অন্তত তিনটি শর্ত মানতে হয়- নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে, লিখতে ও দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব-নিকাশ কষতে পারা। প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত এই সংজ্ঞা ব্যবহার করলে দেশের প্রায় অর্ধেক লোকই বাদ পড়বে সাক্ষরতার তালিকা থেকে। যদিও সরকারি হিসাবে এ দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭০ শতাংশ। এর সাথে অবশ্য সম্পৃক্ত দ্বিবিধ ছলনা- ইউনেস্কো নির্ধারিত সংজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়া ও পরিসংখ্যানে পানি মেশানো, মানে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো। কালে কালে যা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রচার-কার্যক্রম। ক্ষমতায় যারা থাকেন, তারা ‘নিরক্ষর’দের অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করে তোলায় বিপুল সাফল্যের কথা জোর গলায় বলেন।
৮ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস এলেই উঠে আসে বিষয়টি। প্রতি বছর এক থেকে দুই শতাংশ হার বাড়িয়ে সরকারি প্রচারণাকে অন্তঃসারশূন্য দাবি করেন কেউ কেউ। কারও দাবি- বিষয়টিতে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকে বিস্তর। অনেকে আবার এর মধ্যে খুঁজে পান ‘শিক্ষা-বাণিজ্য’, বয়স্কদের শিক্ষাদানের নামে বিশেষ মহলের দেশ-বিদেশের অর্থ সংগ্রহের ধুম। তাতে কাজের কাজ তেমন না হলেও, ঠিকই কপাল খুলে যায় সংশ্লিষ্টদের।
তাত্ত্বিকতার প্যাঁচ
শিক্ষিত কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়- দেশে শিক্ষার হার কত? সাথে সাথে তিনি সাক্ষরতার হারকেই উল্লেখ করবেন। প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগ মানুষই এ দুয়ের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন নন। অথচ শিক্ষা ও সাক্ষরতায় রয়েছে মৌলিক ব্যবধান, অর্থাৎ শিক্ষার পথে সাক্ষরতা একটা ধাপ মাত্র।
এডুকেশন ওয়াচের এক জরিপে দেখা গেছে, যারা প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন, কিন্তু কোনো কারণে মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হতে পারেননি, তাদের ৩৫.৬ শতাংশ মানুষ পরবর্তী সময়ে সাক্ষরতার পরীক্ষায় ফেল করে। অর্থাৎ কাগজে-কলমে স্বাক্ষর হয়েও বাস্তবে তারা নিরক্ষর।
সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে, যাদের অন্ততপক্ষে ছয় থেকে সাত বছর বিদ্যালয়ে পড়ালেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের ৮০ শতাংশই একটি নির্দিষ্ট সময় পর চর্চার অভাবে সাক্ষরতার অবস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হননি। তার মানে, পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করা একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট সময় পর পড়ালেখা পুরোপুরি ভুলে যাচ্ছেন।
এখন সরকারের পক্ষ থেকে সাক্ষরতার যে হার দাবি করা হচ্ছে, সেটির নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু- সেই প্রশ্নও তুলেছেন শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ। তাদের মতে, শিক্ষার সাথে সাক্ষরতার সম্পর্ক যে নাও থাকতে পারে, এ তথ্য-ই সেটি প্রমাণ করে দেয়।
হার-এ নেই ধার
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের হিসাবে দেশে ৫০ থেকে ৬৭ বছর পর্যন্ত সাক্ষরতার হার ৭৩.৩ শতাংশ ও সাত থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ৭৩.২ শতাংশ। তবে বেসরকারি সংস্থা ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’ ২০১৬ সালে সাক্ষরতার হার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, সাক্ষরতার হার ৫১.৩ শতাংশ। তবে বর্তমানে এনজিওগুলোর কোনো জরিপ না থাকলেও বেসরকারি হিসাবে এর হার ৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
সাক্ষরতার হার নিয়ে বিবিএসের তথ্যে অবশ্য বিভ্রান্তি রয়েছে। মূলত সংস্থাটি কোনো লোকের কাছে জানতে চায়- আপনি লিখতে পারেন? ওই ব্যক্তি বলেন, পারি; কিন্তু তাকে যদি এক পৃষ্ঠা লিখতে দেয়া হয় হয়তো পারবেন না। কেবল নিজের নামটুকুই লিখতে জানেন। অথচ বিবিএস তাকেও সাক্ষরতার আওতায় নিয়ে আসে।
আর বেসরকারি জরিপে একজন ব্যক্তি লিখতে ও পড়তে পারে কি না, তা যাচাই করা হয়। এখন প্রশ্ন থেকেই যায়- সরকারিভাবে যাদের সাক্ষর হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সবাই কি আসলেই সাক্ষর?
রাজধানীর কাছের জেলা মানিকগঞ্জের তেরদোনা গ্রামের শিউলী বেগম। ২০১০ সালে সরকারের বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষার্থী হিসেবে শিখেছিলেন নিজের নাম লেখা ও প্রাথমিক বর্ণপরিচয়। তিনি জানালেন, সই করতে পারলেও ভুলে গেছেন পড়তে পারা। ফলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় কোনো সহায্য করতে না পারায় তার অনেক আক্ষেপ। আরো ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে ওই কার্যক্রমের শিক্ষক মহিনাজ পারভীনের দেয়া তথ্যে। তিনি বললেন, ‘ওই সময় অনেককে পড়ালেখা শেখালেও চর্চার অভাবে আজ আমি নিজেই সব ভুলতে বসেছি।’
দক্ষে নেই লক্ষ্য
সাক্ষরতার হার বাড়ায় দিন দিন বেড়ে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও; কিন্তু বাড়েনি শিক্ষার মান। গবেষণা খাতেও রয়ে গেছে ঘাটতি, সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না কারিগরি শিক্ষার। ফলে দেশে দক্ষ ও অভিজ্ঞদের সংখ্যা কমছে। সেক্ষেত্রে বিদেশ থেকে কর্মী এনে চলছে উন্নয়ন যাত্রা।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মকর্তারা পারিশ্রমিক হিসেবে ২০০ কোটি ডলারের বেশি নিজেদের দেশে নিয়ে গেছেন। টাকার অংকে হিসাব করলে দাঁড়ায় ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। এসব বিদেশি কর্মকর্তার বেশিরভাগই চীনের।
দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ও মেধাবী তরুণদের সম্পৃক্ত করতে আমাদের অদক্ষতা ও সিদ্ধান্তহীনতা, সর্বোপরি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। অথচ ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষার মাধ্যমেই জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।’
আলোর গায়ে কালো
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল; কিন্তু সাক্ষরতার হার বাড়াতে তেমন কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই কবে নাগাদ দেশ নিরক্ষরমুক্ত হতে পারে, তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
যদিও ২০৩০ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করা বাধ্যতামূলক। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক তপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘বর্তমানে যে প্রকল্পগুলো চলছে সেগুলো আমরা কঠোরভাবে মনিটর করছি। নতুন প্রকল্পগুলো পাস হলে সাক্ষরতা কার্যক্রম আরও জোরদার হবে।’
সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, নিরক্ষরতা দূরের নামে ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নেয়া সব প্রকল্পের ব্যাপারেই আছে নানা অভিযোগ। এমনকি বয়স্ক শিক্ষাকে ঘিরে কোনো প্রকল্পেরই সফলতার ইতিহাস নেই। তাই দাতা সংস্থাগুলোও এক সময় মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর সরকারই নিজস্ব অর্থে ৪৫ লাখ নিরক্ষরকে মৌলিক সাক্ষরতা ও জীবনদক্ষতা দিতে ৪৫০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। এটিও শুরুতেই বিতর্কের মুখে পড়ে। অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে নিরক্ষরতা দূরের কাজ দেয়া হয় ভুঁইফোঁড়, নাম-ঠিকানাবিহীন ও জাল-জালিয়াতির দায়ে চিহ্নিত কিছু এনজিওকে।
বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে সরকারিভাবে সোয়া তিন ও বেসরকারিভাবে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি লোক নিরক্ষর। এ ব্যাপারে গণসাক্ষরতা অভিযানের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি প্রচেষ্টার বাইরে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা দেশে সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে গেলেও তা বেশ ধীরগতিসম্পন্ন, বছরে মাত্র ০.৭ শতাংশ। অগ্রগতি যদি এ হারে চলতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের সব নাগরিকের সাক্ষরতা দক্ষতার প্রাথমিক স্তরে পৌঁছাতেই আরো ৪৪ বছর ও অগ্রসর পর্যায়ে উন্নীত হতে ৭৮ বছর লাগবে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘প্রকৃত নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করতে যে ধরনের কার্যক্রম দরকার, গত দুই দশকে তা নেয়া হয়নি। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির পেছনে নিরক্ষরতা দূর করার কর্মসূচির কোনো অবদান নেই। গোটা অবদানই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার।’