Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

গ্যাস বোমায় বসবাস

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:১৬

গ্যাস বোমায় বসবাস

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণে হতাহতদের স্বজনদের আহাজারি। ফাইল ছবি

দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে তিতাস গ্যাসের অবৈধ ও নিম্নমানের সংযোগগুলো দিন দিন পরিণত হচ্ছে ভয়ংকর গ্যাস বোমায়। ফলে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের মতো ঘটনা যেকোনো সময় ঘটতে পারে দেশের বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনায়।

অবৈধভাবে ছড়িয়ে থাকা এসব গ্যাস লাইন থেকে সৃষ্ট লিকেজের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থান, বিশেষ করে তিতাস গ্যাসের আওতাধীন রাজধানীর আশপাশের নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলার লাখো মানুষ রয়েছেন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে। যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের বিস্ফোরণ। 

আর এসব লিকেজ, অবৈধ সংযোগ ও নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করে তিতাস গ্যাস ও সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর কিছু অসাধু চক্র প্রশাসনের নাকের ডগায় বসেই মাইলের পর মাইল ও গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে দিচ্ছে গ্যাস সংযোগের নামে গ্যাস বোমা। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে, বিচ্ছিন্নভাবে প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করে মাটির ওপর দিয়ে সংযোগ বিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। ফলে এলাকাগুলো হয়ে উঠছে বিপজ্জনক।

এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব আনিসুর রহমান বলেন, ‘বাঁশের খুঁটি ব্যবহার করে প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে যেসব বাড়িঘরে অবৈধ গ্যাস সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে, তার সবই বিপজ্জনক মনে করা হচ্ছে। তিতাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্টিবিউশন কোম্পানির আওতায় থাকা এলাকায় এমন সংযোগের পরিমাণ প্রায় দুই লাখ হবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘খুব দুঃখজনকভাবে আমরা শুধু কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই এসব নিয়ে কথা বলি। ফলে নাগরিকদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতা গড়ে ওঠে না।’ 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জেই সর্বাধিক অবৈধ গ্যাসের সংযোগ রয়েছে এবং এই সংযোগকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। নারায়ণগঞ্জের পর অবৈধ সংযোগে এগিয়ে আছে সাভার, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও টাঙ্গাইল। এসব সংযোগ প্রদান করার সময় গ্রাহকদের পর্যায়ক্রমে এগুলো বৈধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এমনকি জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা ‘ভোটে জিততে পারলে এসব সংযোগ বৈধ করে দেয়া হবে’ বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই এসব অবৈধ সংযোগ টিকে থাকে।

ফতুল্লার মসজিদে বিস্ফোরণের মাত্র কয়েক দিন আগে ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বন্দরের কলাগাছিয়া ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের ছয় হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় নয় কিলোমিটার অবৈধ পাইপ লাইন তুলে ফেলা হয়। জানা যায়, বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের ৯/১০টি গ্রামের বাসিন্দা অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে রান্নাবান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহার করছিলেন।

সরকারের বিভিন্ন দফতর ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নানা সময়ে তদন্ত করে এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা জানতে পেরেছে। গত বছর দুদকের সুপারিশের ভিত্তিতে মোট দুই হাজার ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ৪৩ শতাংশকেই অনত্র বদলি করেছে তিতাস।

গ্যাস বোমার ঝুঁকিতে আড়াই কোটি মানুষ

জানা গেছে, সংযোগের নামে গ্যাস বোমার চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকার প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। রাজধানীর মাটির নিচে জালের মতো ছড়িয়ে আছে গ্যাসের জরাজীর্ণ লাইন। বৈধ লাইনের সমান্তরালে গড়ে উঠেছে অবৈধ ও নিম্নমানের লাইনও। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈধ লাইনগুলো মাঝে মাঝে সংস্কার করা হলেও অবৈধ লাইনের কোনো সংস্কার হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবৈধ লাইনগুলো টানা হয়েছে নিম্নমানের পাইপ আর জোড়াতালি দিয়ে। প্রায় ৫৬ বছরের পুরনো এ ধরনের গ্যাসলাইন এখন ছোট ছোট বোমায় পরিণত হয়েছে। যার কারণে প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ; কিন্তু তারপরও সংস্কারের পরিবর্তে বিতরণ কোম্পানিগুলোর বেশি খেয়াল নতুন সংযোগের দিকে। কারণ সংযোগ হলেই অনেক প্রাপ্তির সুযোগ থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী মো. আল-মামুনের দাবি, ‘গ্যাসলাইনে যত দুর্ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে তিতাসের ত্রুটি বা দুর্বলতার জন্য ঘটছে ১০ শতাংশ। বাকি ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে অন্য সেবা সংস্থার জন্য। দেখা যাচ্ছে, ওয়াসা তাদের পানির লাইনের সংস্কার কাজ করছে। কাজ করার সময় তিতাসের গ্যাসলাইন লিকেজ করে দিল; কিন্তু অনেক সময় বিষয়টি তাদের জানানোও হয় না। আবার জানানোর পর টিম সেখানে যাওয়ার আগেই আগুন লেগে যায়। সব সেবা সংস্থার সরবরাহ লাইনের কাজ সমন্বিতভাবে করার প্রক্রিয়া চলছে। এটি করা সম্ভব হলে অনেক দুর্ঘটনা কমানো যাবে।’

তিতাসের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের সুপারিশ

গত বছরের এপ্রিলে তিতাসের দুর্নীতি প্রতিরোধে ১২ দফা সুপারিশ দিয়েছে দুদক। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- ডিস্ট্রিবিউশন ও গ্রাহক উভয়ক্ষেত্রে প্রিপেইড মিটার চালু করা, আকস্মিক পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর ফলোআপে রাখা, শিল্প এলাকায় দীর্ঘদিন পোস্টিং না রাখা, জনবলের দক্ষতা বাড়ানো, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি, অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ, অডিট আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা, সিস্টেম লসের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ, নিজস্ব সার্ভিলেন্স এবং মোবাইল কোর্ট, নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ, বকেয়া পাওনা আদায়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রভৃতি।

দুর্নীতির সম্ভাব্য খাত

দুদকের প্রতিবেদনে তিতাসের দুর্নীতির সম্ভাব্য খাতগুলো হলো- অবৈধ সংযোগ, নতুন সংযোগে অনীহা এবং অবৈধ সংযোগ বৈধ না করা, অবৈধ লাইন পুনঃসংযোগ, অবৈধ সংযোগ বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ না নেয়া, অদৃশ্য হস্তক্ষেপে অবৈধ সংযোগ, গ্যাস সংযোগে নীতিমালা অনুসরণ না করা, বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহককে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ প্রদান, মিটার টেম্পারিং, অনুমোদনের অতিরিক্ত বয়লার ও জেনারেটরে গ্যাস সংযোগ, মিটার বাইপাস করে সংযোগ প্রদান সংক্রান্ত দুর্নীতি, এস্টিমেশন অপেক্ষা গ্যাস কম সরবরাহ করে সিস্টেম লস দেখানো, ইচ্ছাকৃতভাবে ইভিসি (ইলেকট্রনিক ভলিউম কারেক্টর) না বসানো ইত্যাদি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫