Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বৃদ্ধাশ্রম: জীবনের শেষ অধ্যায়

Icon

বিশেষ প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২০, ১২:৫০

বৃদ্ধাশ্রম: জীবনের শেষ অধ্যায়

পরিবার থেকে বিতারিত বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল হিসেবেই মূলত পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছিলো চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিলো শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতারিত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থাই। ছিল খাদ্য ও বিনোদনব্যবস্থা।

বৃদ্ধদের আরাম আয়েশ ও বিনোদনব্যবস্থা নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের শুরু হলেও, আজো বৃদ্ধাশ্রম নামটি শুনলেই চোখের সামনে ধরা দেয় ক্রন্দনরত মায়ের মুখ, ম্রীয়মান বাবার দুর্বল চাহনি। মনে পড়ে যায় নচিকেতার বিখ্যাত গান-

ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার ।
নানান রকম জিনিস, আর আসবাব দামি দামি
সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি।
ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!

গানের এই চিত্র দেখতে পাওয়া যায় প্রায় প্রতিটি বৃদ্ধাশ্রমের প্রত্যেক সদস্যদের। তেমনই একজন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হিতৈষী নিবাসের সদস্য মাসুদা ( ছদ্দনাম)। দুই ছেলে-দুই মেয়ে থাকলেও বিগত সাত বছর ধরে এখানেই তার বসবাস। আত্মীয়- পরমআত্মীয় এখন এখানকার মানুষজন। মাসুদার কাছে নিজের ছেলে মেয়ের কথা জানতে চাইতেই হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাত বছর আগে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছেলের পরিবারে কথা কাটাকাটি হলে তাকে রেখে যাওয়া হয় এই আশ্রমে। এরপর থেকে আর দেখতে আশেনি কেউ। একাধিকবার ফোন করেও কোনো লাভ হয়নি।

এই গল্প কেবল এক মাসুদার নয়, বৃদ্ধাশ্রমের প্রায় প্রতিটি মাসুদার।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গড় আয়ু বেড়ে দেশের মোট জনসংখ্যার সাত ভাগ প্রায় সোয়া এক কোটি এখন প্রবীণ জনগোষ্ঠী। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হবে প্রায় ২০ ভাগ। কিন্তু এই সংখ্যাটা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বেড়ে যাচ্ছে হতাশাও।

একটি জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ শতাংশ বৃদ্ধের এক বা একাধিক সন্তান বাইরে থাকে। অর্থাৎ, তাদের সাথে তাদের পিতামাতার যোগাযোগ খুব তেমন একটা নেই।  আর শতকরা ২০ জন, দরিদ্র প্রবীনদের শতকরা ৩৭ জন একাকী থাকেন অথবা কেবল স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে থাকে। 

এদিকে, সরকার প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করাসহ বেশ কিছু সুবিধা চালু করা হয়েছে। এছাড়া, সরকার কর্তৃক সহায় সম্বলহীন প্রবীণদের জন্য ৬টি বিভাগে ৬টি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও বেশ কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উড়েছে। তবে দেশে মোট কতজন প্রবীণ এই  বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বসবাস করছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারিভাবে নেই।

তবে বেসরকারি সংস্থা প্রবীণ হিতেষী সংঘের হিসাবে, দেশের এক কোটি ১৭ লাখের বেশি প্রবীণের মধ্যে অনেকেরই নেই জীবন যাপনের নিশ্চয়তা। ২০৫০ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে সাড়ে চার কোটি, জনসংখ্যার প্রতি পাঁচ জনের একজন হবে প্রবীণ।

প্রবীণদের হতাশা, অনিশ্চয়তা দিনদিন বেড়েই চলেছে। নিজেদের নিয়ে শঙ্কা বা সংশয় কোনোটিরই নিশ্চয়তা নেই দেশের এই ১৭ লাখ প্রবীণের কাছে। সমাধানও জানা নেই। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশকে এই শঙ্কা থেকে মুক্ত করতে পারে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন।

এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন একটি গণমাধ্যমকে দেয়া স্বাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “গ্রামগঞ্জে তো অবশ্যই, এমন একটা সময় ছিল, যখন এই ঢাকা শহরে ঘরে ঘরে যৌথ পরিবার ছিল। আধুনিক নগরায়ণের কারণে আমাদের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারে মা-বাবা আর সন্তানের প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। নানা-নানি কিংবা দাদা-দাদি—পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রাধাণ্য দেখা যায় না। যদিও কোনো পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠরা থাকেন, তবে তাদের দেখা যায় কোনো রকম আশ্রিত মনোভাব নিয়েই থাকতে হয়। অথচ আগে পরিবারের মুরব্বিরাই প্রধাণ হর্তাকর্তা ছিলেন। একটি পরিবারকে অটুট বন্ধনে বেঁধে রাখতে মুরব্বিদের অভিজ্ঞতা পরিবারের সবার চলার পাথেয় হিসেবে কাজ করে। নাগরিক এই ভাঙনের সুর, এই বৃদ্ধাশ্রম বেড়ে যাওয়া, মানুষের শেষ সময়ের আশ্রয় এখন বৃদ্ধাশ্রম হওয়ার ক্ষেত্রে। আমার মনে হয়, মানসিকতার পরিবর্তন অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। আর অর্থনৈতিক ঘড়ির কাঁটায় যখন জীবন ঘোরে, তখন মানুষ খুব হিসাবি হয়ে ওঠে। মা-বাবার ভরণপোষণ নিয়ে সন্তানকে থাকতে হয় টানাপড়েনে। এটাকে আমি মানসিক বৈকল্যই বলব। একটু মনের ইচ্ছা-সহনশীলতা, শ্রদ্ধা আমাদের বাবা ও দশভুজা মায়েদের জীবনের শেষ সময়টাকে এভাবে নিঃসঙ্গ করে দিত না। আর এ জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। নাতি-নাতনি নিয়ে হেসে-খেলে যে সময় পার করার কথা, তখন তাদের কাটাতে হয় নিঃশব্দে, নিঃসঙ্গতায় “

প্রসঙ্গত, প্রবীণদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে ১ অক্টোবর সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৪৫/১০৬ নম্বর প্রস্তাবে ১ অক্টোবর দিনটি প্রবীণদের জন্য পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় সারাবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। পরিবারের বয়স্কদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতি বছর বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে এ দিবস।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫