ধর্ষণ প্রতিরোধে ‘ক্রসফায়ারের’ প্রতি ঝোঁক বাড়াচ্ছে ‘বিচারহীনতা’

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২০, ২০:৫২

ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি বাংলাদেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার কারণে আবারো আলোচনায় এসেছে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সংবিধান পরিপন্থি এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে মনে করে দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে ২০০৪ সালের পর থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ‘ক্রসফায়ার’ নাম নিয়ে আলোচনায় স্থান দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও চিত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ‘ক্রসফায়ার’ ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, ধর্ষণের মতো নিষ্ঠুর ঘটনা বন্ধ করতে হলে ধর্ষণকারীদের শাস্তি হিসেবে ‘ক্রসফায়ার’ দিতে হবে অর্থাৎ, তাকে বিনা বিচারে হত্যা করতে হবে- যাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর প্রতি ভয় তৈরি হয়। এমনকি এ ধরনের কিছু ফেসবুক গ্রুপও তৈরি করা হয়েছে।
আবার অনেকেই বলছেন যে, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে আসলে ধর্ষণের মতো অপরাধ থামানো সম্ভব নয়। তবে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আদৌ কোনো সাংবিধানিক বা নৈতিক ভিত্তি আছে কি না, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা চোখে পড়ছে না।
রহিম উদ্দিন শিকদার নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী বলেছেন, ‘নোয়াখালীর ধর্ষকসহ সকল ধর্ষণকারীদের ক্রসফায়ার দিন। ক্রসফায়ারই এদের জন্য একমাত্র বিচার।’
আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী তানভীর আহমেদ তার স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘ধর্ষণকারীর ক্রসফায়ার হোক।’
তবে অনেক ব্যবহারকারীই আবার ক্রসফায়ারের বিষয়টির বিপক্ষে আওয়াজ তুলেছেন। এরকমই একজন জায়াদুল আহসান পিন্টু বলেছেন, ‘আপনি যেমন ক্ষমতার বলে ক্রসফায়ার চান, ধর্ষকও ক্ষমতার বলেই ধর্ষণ করে। বিষয়টা একই।’
আহসানের এই কথাকে সমর্থন করেছেন আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী তপন মাহমুদ লিমন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ২০১৮-২০১৯ সালে ৪২৪ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ কি মাদকমুক্ত হয়েছে? কতদিন ধরে এই ক্রসফায়ার চালালে সব নিয়ন্ত্রণে আসবে? দয়া করে জানাবেন?’
দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব বলছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় বিশ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৪০০২ জন মানুষ।
গত দুই বছরে যতগুলো ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই মাদকবিরোধী অভিযানে হয়েছে বলে এর আগে জানিয়েছিল পুলিশ। তবে এরপরও মাদকের চোরাচালান বা এ সম্পর্কিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘গত কয়েক বছরে, বাংলাদেশে একের পর এক ক্রসফায়ারে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বা অপরাধ প্রবণতা এখন পর্যন্ত কমেনি।’
এ বিষয়ে মানবাধিকার আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযানে যাদেরকে ক্রসফায়ারে দেয়া হচ্ছে তারা খুবই চুনোপুঁটি ধরনের মানুষ।’
তার মতে, ‘যারা ক্ষমতাবান, যারা মাদক চোরাচালানের পেছনে বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করছে, তারা কখনোই ক্রসফায়ারে পড়ছে না বা দেয়া হচ্ছে না। বরং এদের মধ্যে অনেকের নাম আসার পরেও উল্টো তারা রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান পাচ্ছেন, এমনকি জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হচ্ছেন।’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ক্রসফায়ার দিয়ে কি ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব?
ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কি আসলে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমাতে বা বন্ধ করতে পারবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মানবাধিকার কর্মী এবং ধর্ষণ নিয়ে কাজ করা অ্যাক্টিভিস্টরা সবাই একমত হয়েছেন যে, ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দিয়ে ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেন, ‘মানুষ আসলে এতো বেশি বিরক্ত হয়ে গেছে, ভয় পাচ্ছে, হতাশ হয়ে গেছে যে তারা ভাবছে যে ক্রসফায়ার হলে হয়তো এর সমাধান আসবে। কিন্তু এটি ভুল ধারণা।’
তিনি মনে করেন, ‘ক্রসফায়ার একটি অনৈতিক এবং অসাংবিধানিক বিষয়। এটা এক ধরনের বিচারহীন মৃত্যু।’
ক্রসফায়ারের প্রচলন চালু হলে কোনো ধর্ষণের ঘটনায় যদি নির্দোষ কারো মৃত্যু হয়, তাহলে সে দায়ভার জনগণ নেবে কি না সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি, ‘আমি কখনোই মনে করি না ক্রসফায়ার করে বা একটা অন্যায় করে আরেকটা অন্যায়কে ঢাকা যায় না।’
একই ধরনের মত দিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী এলিনা খানও। তিনি বলেন, ‘ক্রসফায়ার কখনোই সমাধান হতে পারে না। কারণ এর কারণে নিরপরাধ মানুষও ক্রসফায়ারের শিকার হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘যাকে ক্রসফায়ার দেয়া হবে সে মারা যাবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে যদি মূল্যবোধ, নৈতিকতা না থাকে তাহলে শুধু ক্রসফায়ার দিয়ে কিছু হবে না। একটা সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক দেশে কখনোই ক্রসফায়ার কোনো রেমেডি হতে পারে না।’
আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি বন্ধ এবং যুব সমাজকে কাজে লাগানো না গেলে ধর্ষণ, মাদকের মতো অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
মানবাধিকার-কর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘ক্রসফায়ার একটি বিচারবহির্ভূত ব্যাপার। আর তাই কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত হাতিয়ার ব্যবহারের পক্ষে নন তিনি, যারা ক্রসফায়ারকে ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন তারা মূল বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন। যে দেশে গণতন্ত্র থাকবে, সংবিধান থাকবে এবং আইন আছে, সেখানে আইনের যথাযথ প্রয়োগটাই জরুরি।’
ক্রসফায়ার হবে অরাজকতা
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ক্রসফায়ার যদি বৈধতা পায় তাহলে যে সমস্যা হবে তা হলো প্রায় সব মানুষ আইন হাতে তুলে নেয়ার জন্য উদ্যত হবে।
‘জমি-জমা, সম্পত্তির হিসাব বা অন্য যেকোনো শত্রুতা থাকলেও মানুষ একে অন্যকে মেরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করবে না এবং অভিযোগ তুলবে যে সে আমাকে ধর্ষণ করতে এসেছিল’, বলেন মানবাধিকার-কর্মী শিপা হাফিজা।
তার মতে, ধর্ষণ বাড়ছে বিচারহীনতার জন্য। কারণ এ ঘটনায় বিচার হচ্ছে না, বিচার দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আর এর জন্য সমাধান হিসেবে যদি ক্রসফায়ার বৈধ হয়, তাহলে সেটি হবে অরাজকতা।
‘একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে এ ধরনের অরাজকতা কখনো আমরা চাইতে পারি না। বাংলাদেশ তখন স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক দেশ বলে আর পরিচিত হবে না’, বলেন শিপা হাফিজা।
তার মতে, ক্রসফায়ার একটি ভয়ংকর বিষয় যেখানে জবাবদিহিতা থাকে না। আর যেখানে জবাবদিহিতা থাকে না সেখানে সুশাসনও থাকে না।
নুর খান লিটন বলেন, ‘এটি সমাজের সর্বস্তরে বৈধতা পেলে আইনের শাসন আর থাকবে না। বরং হত্যার সংস্কৃতি, প্রতিশোধের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। যা আদিম বর্বরতার দিকে মানুষকে নিয়ে যাবে।’
একটি অপরাধ অনেকগুলো অপরাধের জন্ম দেবে বলেও মনে করেন তিনি।
ক্রসফায়ারের প্রতি সমর্থন বাড়ছে কেন?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেন, ২০১৪ সাল থেকে নারী ও শিশুর উপর আগ্রাসন অনেক বেশি হারে বাড়তে থাকে।
তিনি জানান, ২০১৭ সালে দেখা যায় যে, আগের বছরগুলোর তুলনায় সে বছর নারীর উপর সর্বোচ্চ হারে ধর্ষণ এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সর্বোচ্চ হারটা হচ্ছে সেই সব ঘটনার আলোকে যেসব ধর্ষণের ঘটনা সামনে এসেছে বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো। আর এর বাইরে তো অপ্রকাশিত আরো অনেক ঘটনা রয়েই গেছে।
২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে দেখা গেলো যে, দ্বিগুণ সংখ্যক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রায় দেড়গুণ বেশি।
‘এই ক্রমাগত ধর্ষণকে আমরা সংস্কৃতি হিসেবে মেনে নিয়েছে। এটা আমাদের কাছে ডাল-ভাতের মতো একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে’, শিপা হাফিজা বলেন।
তার মতে, ধর্ষণের প্রতি রাষ্ট্র এখনো কোনো ধরনের সুনজর দেয়নি। কারণ দেড়শ বছরের ধরে যে আইন দিয়ে বিচার করা হয়, সেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞায় সমস্যা রয়েছে। আদালত, প্রশাসন-সবক্ষেত্রেই অক্ষমতা রয়েছে।
‘সারা জীবন ভয় পেতে পেতে মানুষের মধ্যে যে হতাশা হয়েছে তা থেকে মানুষ বলছে যে ধর্ষকদের মেরে ফেলো। কিন্তু খুব বেশি দিন নাই যখন হতাশা ক্ষোভে রূপ নেবে, তখন মানুষকে সামাল দিতে রাষ্ট্রের সমস্যা হবে’।
তার আগেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
মানবাধিকার আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ‘ধর্ষণের বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা থাকলেও সেটি না হয়ে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। এক্ষেত্রে শুধু আদালত নয় বরং থানা পর্যায় থেকে দীর্ঘমেয়াদি শুরু হয়।’
‘একটি ধর্ষণের ঘটনায় তদন্ত করা, চার্জশিট দেয়া, আসামির সুরক্ষার মতো নানা স্পর্শকাতর বিষয় থাকে। এগুলোতে জোর না দেয়ার কারণে সুশাসন মানুষ পাচ্ছে না।’
ফলে বিচার না পাওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের চরম হতাশা তৈরি হয়।
‘মানুষ ভাবছে যে যেখানে আইন থাকার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না, বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে তাহলে মেরেই ফেল। ক্রসফায়ারের দাবিটাও তারই বহিঃপ্রকাশ,’ বলেন এলিনা খান।
মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষের মনে এ ধরনের একটি অবস্থা তৈরি করে। এছাড়া ক্ষমতা প্রদর্শনের রাজনীতির কারণে মানুষের মনে আশঙ্কা থাকে যে অপরাধীরা তাদের ক্ষমতা, অর্থ এবং অবস্থানের কারণে হয়তো পার পেয়ে যাবে।’
যার কারণে তাদের মধ্যে একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয় যে ক্রসফায়ারই একমাত্র সমাধান। বিচার ব্যবস্থাকে যথাযথ করা হলে মানুষকে এ ধরনের চিন্তা করতে হতো না বলেও মনে করেন তিনি।
সমাধান কী হওয়া উচিত?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণ বন্ধের ক্ষেত্রে যে দাবি ওঠা উচিত সেটি হচ্ছে দ্রুত বিচার এবং সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কোনো অন্যায় যেন বিচারের বাইরে না থাকে সেটি নিশ্চিত হতে হবে।
তারা বলছেন, বিচার নিশ্চিত হলে যারা ধর্ষক বা যারা সমর্থন দেয় তারা বুঝতে পারবে যে এটা কত জঘন্য অপরাধ। তাহলে তারা এটা থেকে বিরত থাকবে।
এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয় গত জুলাইয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার ঘটনা।
শিপা হাফিজা বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রতিবাদ হলেও তা বন্ধ হয়নি। কিন্তু সিনহার হত্যার পর যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বুঝতে শুরু করলো যে এ ঘটনায় বিচার হবে তখন কিন্তু ক্রসফায়ার বন্ধ হয়ে গেছে। গত দুই মাসে মাত্র একটি ক্রসফায়ার হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাষ্ট্রই পারে সমাজকে একটা সংস্কৃতি দিতে যেখানে নারী-পুরুষ সবাই স্ব-সম্মানে থাকতে পারে। ক্রসফায়ার বিষয়টি এই সবগুলো বিষয়ের একটি উল্টো দিক বলে মনে করেন তারা।
সূত্র: বিবিসি বাংলা