ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাড়া জাগিয়েছে মাল্টার চাষ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২০, ১০:০৫

ছবি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাড়া জাগিয়েছে মাল্টার চাষ। সিট্রাস জাতীয় ফল মাল্টা চাষ করে আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছেন প্রবাস ফেরত আব্দুল আলিম। লাভজনক হওয়ায় বেগুনের চাষাবাদ ছেড়ে এখন তিনি মাল্টার চাষ করছেন। চলতি মৌসুমে বাম্পার ফলন হওয়ায় লক্ষাধিক টাকা আয় হবে বলে আশা করছেন তিনি।
লাভজনক হওয়ায় প্রকল্প ছাড়াও এখন সাধারণ মানুষও ঝুঁকছে মাল্টা চাষে। শুরুতে জেলায় চারটি বাগান দিয়ে মাল্টা চাষের সূচনা হলেও এখন ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় এক হাজার ৮০০ মাল্টার বাগান রয়েছে। সীমান্তবর্তী জনপদে বাড়ছে নতুন উদ্যোক্তাদের সংখ্যা। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেকেই। চলতি মৌসুমে প্রায় ১৩ কোটি টাকার মাল্টা উৎপাদিত হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
বেকারত্ব ঘোচাতে দীর্ঘ ২০ বছর প্রবাসে ছিলেন বিজয়নগরের আব্দুল আলিম। সৌদি আরব, কাতার, ব্রুনাইয়ে দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে ২০১৩ সালে দেশে ফিরেন। সিদ্ধান্ত নেন এবার দেশেই কিছু করবেন। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে শুরু করেন মাল্টার চাষ। ২০১৩ সালে নিজ বাগানে ৪০ শতাংশ জায়গায় মাল্টার চাষ শুরু করেন। প্রথমে তার বাগানে ৭৩টি চারা থাকলেও এখন বাগানের পরিধি আরো বেড়েছে। বাম্পার ফলন হওয়ায় খারচ বাদেও চলতি মৌসুমে তার লক্ষাধিক টাকা লাভ হবে বলে আশা করছেন। তার মতো অনেকে মাল্টা চাষে ঝুঁকছেন।
জেলার বিভিন্ন স্থানে মাল্টা চাষ হলেও বিজয়নগরের আবহাওয়া মাল্টা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। এখানে আবাদকৃত মাল্টার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বারী-১ ও বারী-২। চলতি মৌসুমে মাল্টার ফলন ভাল হওয়ায় চাষিরা খুবই উৎফুল্ল। জেলার প্রায় ৭৬ হেক্টর জমিতে মাল্টার চাষ হচ্ছে। ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা আসছেন মাল্টা কিনতে। প্রতি কেজি মাল্টা ১৫০ টাকা দরে বাগান থেকেই নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা। দিন দিন জেলায় বাড়ছে মাল্টা বাগানের সংখ্যা। ২০১৩-১৪ সালে সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ২০১৪/১৫ অর্থবছরে প্রথম মাল্টার চাষ শুরু হয়।
করোনাঘাতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বঅর্থনীতি। তবে মহামারির এই দুঃসময়েও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেড়েছে মাল্টা ফলের চাহিদা। দৈনিক ৮০ হাজার থেকে এক লাখ কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফলের আড়তগুলাতে। চিকিৎসকরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সমৃদ্ধ বিভিন্ন ফল খেতে বলছেন। এর ফলে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ মাল্টার চাহিদা বেড়ে এখন দ্বিগুণ হয়েছে। আর তাই এবারের মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মাল্টা চাষীরা প্রায় ১৩ কোটি টাকার মাল্টা বিক্রির আশা করছেন।
মাল্টা চাষের জন্য কৃষি অফিস থেকেই বিনামূল্যে চাষিদের চারা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। মৌসুমি এ ফল চাষে খরচও তুলনামূলক কম। আর ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাজারগুলোতে বিজয়নগরের উৎপাদিত মালটার চাহিদাও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে একটু বেশি। তবে কৃষকরা দেশীয় মাল্টার বাজার ধরে রাখতে বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা গ্রামের মাল্টা চাষী আলমগীর মিয়া বলেন, আমার তিন বিঘা জমিতে এবারের মৌসুমে প্রায় সাত টন মাল্টা উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। করোনাভাইরাসে আমাদের ব্যবসায় কোনো প্রভাব পড়েনি, উল্টো মাল্টার চাহিদা আরো বেড়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের বাসিন্দা মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী মো. মশিউর রহমান জানান, বাজারে মাল্টার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবারের মৌসুমের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকায় খাটিঙ্গা গ্রামের একটি মাল্টা বাগান কিনেছেন। এ বাগান থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি।
বিজয়নগর উপজেলার আউলিয়া বাজারের ফল ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক জানান, এখন দোকানে মাল্টা না থাকলে ক্রেতাও কম আসে। অন্য সব ফলের চেয়ে মাল্টা বিক্রি হচ্ছে বেশি। বিশেষ করে ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় বিজয়নগরের ফলের দোকানগুলোতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে স্থানীয় উৎপাদিত মাল্টার চাহিদা বেশি।
বিজয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খিজির হোসেন প্রামাণিক বলেন, বিজয়নগরের জন্য মাল্টা খুবই সম্ভাবনাময় একটি ফল। গত মৌসুমে বিজয়নগরে প্রায় পাঁচশ মেট্রিক টন মাল্টা উৎপাদিত হয়েছিল। এবারের মৌসুমে উৎপাদন বেড়ে আটশ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে এবং সামনের মৌসুমে উৎপাদন আরো বাড়বে। চাষীরা এখন মাল্টা চাষে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে আগামী মৌসুম থেকে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাতকরণের পাশাপাশি বিদেশেও মাল্টা রফতানি করা সম্ভব হবে।
ফল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেও মাল্টা ফলের বেচাকেনা বেড়েছে। মহামারির প্রকোপ শুরুর আগে জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কেজি মাল্টা বিক্রি হতো। আর লকডাউনের পর থেকে বেচাকেনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ কেজির বেশি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফলের আড়তগুলোতে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও সরাইল-বিশ্বরোড ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও থ্রিস্টার ফলের আড়তের সত্ত্বাধিকারী এস. কে. লিটন ফরাজী বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কেজি মাল্টা বিক্রি হতো জেলার ফলের আড়তগুলোতে। কিন্তু গত জুন মাসের পর থেকে মাল্টার বেচাকেনা বেড়েছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ্ বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আমরা সর্বপ্রথম স্বভাবিক খাবার খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলি। এরপর শারীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর ও ভিটামিন সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবার পরিমিত মাত্রায় খাওয়ার জন্য বলা হয়। ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ লেবু, মাল্টা, কমলা, বাতাবি লেবু, আমলকি ও আমড়ার মতো ফলগুলো করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আর ফলের ক্ষেত্রে দেশীয় ফল খাওয়াই ভালো, কারণ বিদেশি ফলে নানা ক্ষতিকারক কেমিক্যাল থাকে।