
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর বাড্ডায় একটি রুফটপ রেস্টুরেন্ট দিন দিনই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের কাছে। খোলা আকাশের নিচে খাবারের স্বাদ নিতে প্রায়ই ভিড় লেগে থাকে। তবে শুধুই কী রসনাবিলাস নাকি অন্যকিছু? আগ্রহ থেকেই যাওয়া হয় একদিন। লিফট বেয়ে উপরে উঠতেই দেখা মিলে, আশপাশের বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীসহ উঠতি বয়সী সব ছেলে-মেয়ে। জোর আড্ডা গ্রুপে গ্রুপে। তবে যত না খাবার খাওয়া তার চেয়ে বেশি চলছে ধূমপান। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে মেয়েরাও। অথচ একটা সময় ছিল, যখন প্রেমিকার কাছে ভালোবাসার জন্য সিগারেট ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হতো একটি ছেলেকে। আজ পুরোটাই উল্টো- দুই ঠোঁটের মাঝে আলতো করে ধরে লম্বা টান। একরাশ ধোঁয়ার রিং হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ষোড়শী মেয়েটি তার ছেলে বন্ধুটিকে বলে উঠে- ‘কেমন দিলাম? একেই বলে টান।’
এখন আর কেবল রেস্টুরেন্ট কিংবা আড়ালে নয়- নারী, তরুণী ও টিনএজ মেয়েরা প্রকাশ্যেই শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বেসরকারি অফিসে ধূমপান করছেন। এমনিক আগে সিগারেট কিনতে ছেলেবন্ধু, গৃহকর্মী বা কাছের কারও সাহায্য নিলেও বতর্মানে নিজেরাই সরাসরি দোকানে যাচ্ছেন। নিউমার্কেট এলাকার সিগারেট বিক্রেতা আল-আমিনের কণ্ঠেও শোনা গেল একই কথা। জানালেন, ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ এলাকায় পান-সিগারেটের ব্যবসা তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুবাদে এ দোকানে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ও প্রচুর। আল-আমিন বলেন, আমার দোকান থেকে আগেও মেয়েরা সিগারেট কিনত। তবে সংখ্যাটা বেশি ছিল না- সারাদিনে তিন থেকে চারজন হয়তো। তারা মূলত বিদেশি দামি লাইট সিগারেট নিতেন। কিন্তু দুই-তিন বছরে নারী ক্রেতার সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। দেশের প্রায় সব সিগারেট কোম্পানিই এখন লাইট সিগারেট ছেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) সমীক্ষায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারগুলোতে ক্যান্সার নিয়ে একটা সচেতনতা তৈরি হওয়ায় অনেক পুরুষই ধূমপান করছেন না কিংবা করলেও তা কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। অথচ অনেক সচ্ছল পরিবারের নারীরা হাঁটছেন ঠিক উল্টো দিকে। কেননা একুশ শতকে বেশিরভাগ নারী চাকরি করায় হাতে টাকা আসছে যথেষ্ট। তাই স্ট্যাটাস-কনসাসনেসের জায়গা থেকে তারা পুরনো আদল ছেড়ে বের হতে চাইছেন। এর সুযোগ নিচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। ওই নারীদের লক্ষ্য করে তারা সস্তায় লাইট সিগারেট ছাড়ছে। নারীরাও সেই সিগারেট পানে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তাদের ধারণা এসব সিগারেটে তামাক বা নিকোটিনের পরিমাণ কম থাকে, সুতরাং ক্ষতিও কম। এমনকি ঠোঁটও কালো হয়ে যাওয়ার ভয় নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য বলছে অন্য কথা- কোম্পানিগুলো কম নিকোটিনের কথা প্রচার করায়, নারীরা এখন গভীরভাবে টানছেন ধোঁয়া। লাইট সিগারেট টানাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশই নারী। অথচ তারাই সবচেয়ে বেশি এনসিডি বা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রতিবেদন বলছে, দেশে মোট নারীর দুই কোটিরও কিছু বেশি ধূমপানে আসক্ত। আর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালের রেজিস্ট্রি রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনে অভ্যস্ত। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফুসফুস ও মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
মাদকবিরোধী সংগঠন মানস বলছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ নারীর মধ্যে অন্তত তিনজন কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ গবেষণার উদ্বৃতি দিয়ে সংস্থাটির সভাপতি ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ১৫ বছরের বেশি বয়সের ৪৩ শতাংশ লোক তামাকে আসক্ত। তাদের মধ্যে ২৯ শতাংশই নারী। আর ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৫ শতাংশই নানা ধরনের মাদকে আসক্ত। অথচ পাঁচ বছর আগেও সংখ্যাটা অনেক কম ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরোক্ষভাবেও অনেক নারী ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। গবেষণার তথ্য মতে, কর্মক্ষেত্রে ৩০ এবং জনসমাগমের স্থানে ২১ শতাংশ নারী পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।’
বিশ্বে ধূমপায়ীর সংখ্যা নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়া। ২২টি রাষ্ট্রকে নিয়ে করা ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি ধূমপান করেন। এর পরেই আছে ক্রোয়েশিয়া। মানসিক অস্থিরতাসহ নানা কারণেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তামাক আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। কাজের চাপ পড়লেই অফিসের ক্যাবিনেট থেকে বেরিয়ে একটু স্মোকিং জোন খোঁজা। কিংবা সারা দিনের পর রাতের খাওয়া সেরে সুখটান। কেউ দিনে আট-দশটা, কেউ আবার হাওয়ায় মিলিয়ে দেন প্যাকেট প্যাকেট সিগারেট। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটলে নারী ধূমপায়ীর যে চিত্র উঠে আসে তা ভয়াবহ উদ্বেগজনক। এক গবেষণায় দেখায় যায়, ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ছয় গুণ বেশি। এ ছাড়া দেশে ৫.৭ শতাংশ নারী তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ্বের মোট ১৫১টি দেশের অর্ধেকেই সমানসংখ্যক ছেলে-মেয়ে ধূমপান করে। আর বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তামাকসেবনকারীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এর অন্যতম কারণ এসব দেশে জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় টোবাকো কন্ট্রোল অ্যাক্ট এখনো সেভাবে কার্যকর নয়। অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘মোড়ক বা প্যাকেটে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যতিত কোনো তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি কিংবা বাজারজাত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনের এ ধারাটির সঠিক বাস্তবায়নের লক্ষ্যে টোবাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) ২০১৬ সাল থেকে তামাকজাত পণ্যের মোড়কে আইনানুযায়ী সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। এতে দেখা যায়, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী দেয়া হয় ৭৮ শতাংশ তামাকপণ্যের মোড়কে। আর মাত্র ২৬ শতাংশ তামাকপণ্যে শতভাগ আইন মেনে সচিত্র সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হয়।’
পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্যে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন কেবল বিড়ির পেছনেই খরচ হয় ৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। বেসরকারি সংগঠন ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ জানায়, নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা তাদের আয়ের ৪.৫ শতাংশ টাকাই তামাকের পেছনে খরচ করে। আর প্রতিদিন এ শ্রেণির একজন ধূমপায়ী ৭ থেকে ৯ টাকার বিড়ি কেনেন। অন্যদিকে সামাজিকতা ও আর্থিক কারণে দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা এড়িয়ে গেলেও উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রচুর নারী ধূমপানে আসক্ত। তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পার্টি, কনসার্টসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি এমনভাবে পরিবেশ তৈরি করে; যাতে মেয়েরা সাচ্ছন্দ্যে ধূমপান করতে পারেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. লীমা হক বলেন, ‘শহরের অনেক মেয়েই এখন ধূমপানে আসক্ত। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের কাছে ধূমপান নিতান্তই স্বভাবিক ব্যাপার। অনেক মেয়ের কাছে এটি আবার অতিআধুনিকতার নামে এক ধরনের ফ্যাশন। আবার নগরজীবনের তীব্র প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া অনেকেই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। তাদের মধ্যে তৈরি হয় এক ধরনের হতাশা। তখন অনেকেই মাদক ও ধূমপানে অভ্যস্ত হন।’
ধূমপানে নারীর ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুমনা হক বলেন, ‘জরায়ু ক্যান্সারের সঙ্গে তামাক এবং প্রত্যাক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপানের একটা সম্পর্ক গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মায়েলয়েড লিউকেমিয়ার সঙ্গে ধূমপানের অল্পবিস্তর সম্পর্কের প্রমাণও পাওয়া যায়। এ ছাড়া আরও অনেক ক্যান্সারের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- স্কোয়ামাস সেল সাইনোন্যাজাল, লিভার, কলোরেক্টাল, পিত্তাশয়, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির, ক্ষুদ্রান্ত্রের ও শিশুদের বিভিন্ন ক্যান্সার। একজন নারী ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে ৮৫ বছরের আগে ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুর সম্ভাবনা ১১.৯ শতাংশ। অধূমপায়ীর ক্ষেত্রে সেটা প্রায় ০.৮ শতাংশ। এ ছাড়াও বেশকিছু গবেষণায় দেখা যায়, তামাকের সঙ্গে গর্ভপাত এবং ভ্রুণের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ঝুঁকিও বাড়ায়। এমনকি গর্ভবতী মা ধূমপান করলে বা পরোক্ষ স্বীকার হলে কম ওজনবিশিষ্ট শিশুর জন্ম হতে পারে। পাশাপাশি ধূমপান ডিম্বাশয়ের জন্য ক্ষতিকর এবং বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ। ধূমপায়ী নারীর বন্ধ্যা হওয়ার সম্ভাবনাও ৬০ শতাংশ বেশি।’
সম্প্রতি খুলনা বিভাগের পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগের জরিপ চালায় ‘এইড ফাইন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন। তাতে দখা যায়, আইনানুসারে ৫৪.২ শতাংশ গণপরিবহনেই ব্যবহার হয় না ধূমপানবিরোধী সর্তকীকরণ চিহ্ন। শপিংমলগুলোতে ব্যবহার হচ্ছে কেবল ১৬, শিশু পার্কগুলোতে ৩, সিনেমাহলে ১০.৮ এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিকেগুলোতে ২১.৬ শতাংশ। এ ছাড়া ৮.১ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে এবং ২.৮ শতাংশ ট্রেন স্টেশনে এটি ব্যবহার হচ্ছে। তবে বাস টার্মিনালগুলোর কোথাও কোনো সতর্কীকরণ চিহ্ন পাওয়া যায়নি। জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, ২৪ শতাংশ মানুষ ছোট গণপরিবহনে ধূমপান করছে। আদালত এলাকায় ৪, বিপণিবিতানগুলোতে ১২, শিশু পার্কগুলোতে ৮. ৮, সিনেমা হলে ৮, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮, হসপিটাল ও ক্লিনিকে ৪, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১১.৮৩ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে।