করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ: পূর্ণ প্রস্তুতি আবশ্যক

হামিম উল কবির
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:০৫

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কি বাংলাদেশে আসছেই? এটি ঘটতেও পারে, আবার নাও পারে। তবে সবকিছুর জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
আগামী শীতে তাপমাত্রা কমে গেলে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটতে পারে, এমন তত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রার সাথে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়া বা কমার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাপমাত্রা কমলে বাংলাদেশে ফ্লু ভাইরাসগুলো অ্যাক্টিভ হয়ে থাকে। মানুষকে ফ্লু ভাইরাসের োথে করোনাভাইরাসের পার্থক্য শেখাতে পারলে আতঙ্ক কমে যাবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দেশ চীনে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঢেউই নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দ্বিতীয় ঢেউ আসবে কি-না, এমন প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে একেবারেই নগণ্য সংখ্যায়। মাত্র ১২ থেকে ১৫ হাজার মানুষকে পরীক্ষা করা হচ্ছে প্রতিদিন। এই সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা থেকে ১০ থেকে ১১ শতাংশকে করোনায় সংক্রমিত পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ মানুষের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে পারলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রকৃত সংখ্যাটি বেরোতে পারতো বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সংক্রমণের প্রথম ঢেউই শেষ হয়নি বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঢেউই শেষ হয়নি। তা সত্ত্বেও সরকারি পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে- এখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে রয়েছে; কিন্তু এখানে মোট নমুনা পরীক্ষার চিত্রটি মোটেও সুখকর নয়। এখন যে হারে পরীক্ষা হচ্ছে, তা থেকে প্রকৃত চিত্রটি উঠে আসছে না বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এম মোজাহেরুল হক। এ কারণে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে তিনি মনে করেন।
ডা. মোজাহেরুল বলেন, ‘আমরা চাই না আমারে দেশে দ্বিতীয় কিস্তিতে আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ হোক। আমরা চাই, বর্তমান অবস্থা থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হোক। এটি প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে না। নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনাভাইরাস বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে, তা যেন না বাড়ে সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।’
তিনি আরো বলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু আইন বাংলাদেশে আছে; কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো- আইনগুলোর বাস্তবায়ন নেই।’
কীভাবে বুঝব দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে? করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে কি-না, তা চেনা খুব কঠিন নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্রাইটেরিয়া উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. এম মোজাহেরুল হক বলেন, ‘১০ দিনব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নামার পর আবার হঠাৎ বাড়তে থাকলে তখন বলা যাবে- ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। তবে ৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ বাড়লে এটিকে স্বাভাবিকই বলা যাবে। তবে ৫ শতাংশ থেকে ধারাবাহিকভাবে সংক্রমণ উপরে উঠতে থাকলে এবং তা দ্বিগুণের মতো হয়ে গেলেই কেবল বলা যাবে- দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে।’
ইউরোপের দেশগুলোতে বর্তমানে এ অবস্থা চলছে। সেখানে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন চলছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এখনো মোট নমুনা পরীক্ষা থেকে শনাক্তের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ। গত ২৬ অক্টোবর ১৩ হাজার ৭৫৮টি নমুনা পরীক্ষা করে এক হাজার ৪৩৬ জনকে সংক্রমিত বলে শনাক্ত করা হয়েছে, যা মোট নমুনা পরীক্ষার ১০.৪৪ শতাংশ। এ থেকে বোঝা সম্ভব নয় যে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের দিকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোট নমুনা পরীক্ষার ১০ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। এই সংখ্যা হঠাৎ করে দ্বিগুণ হয়ে গেলে তখনই কেবল বলা যাবে- বাংলাদেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউ এলেও তা খুব বেশি বড় হবে না, অথবা এর বিস্তৃতি কম হবে। আগামী শীতে করোনাভাইরাসের সঙ্গে ঠান্ডাজনিত কিছু রোগ দেখা দেবে। এসব রোগের কারণে মানুষ হয়তো পরীক্ষার আগেই করোনা হয়েছে বলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যেতে পারেন। এজন্য আগে থেকে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।’
তিনি জানান, ‘শীতে যে ঠান্ডাজনিত রোগগুলো হয়, সেগুলো কোনো না কোনো করোনাভাইরাসের কারণেই হয়ে থাকে, তবে তা কভিড-১৯ নয়। কোনটা কভিড-১৯ আর কোনটা তা নয়, এ ব্যাপারে জনগণকে জানাতে হবে।’
প্রস্তুত থাকতে হবে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসুক অথবা না আসুক- সব পরিস্থিতির জন্য আমাদের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবুল ফয়েজ বলেন, ‘শিথিলতা দেখানোর কোনো অবকাশ নেই। যতক্ষণ না ভাইরাসটি চলে যায়, ততক্ষণ তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে হবে। একজন আক্রান্ত থাকলেও আমরা কেউই নিরাপদ নই- করোনাভাইরাসের ব্যাপারে এ কথাটি পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। একজন থেকেই হাজার হাজার মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে যেতে পারেন। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারির বিকল্প নেই। বিপজ্জনক এ ভাইরাসের ব্যাপারে সর্বদাই সতর্ক থাকতে হবে। এমনকি ভ্যাকসিন চলে এলেও এই নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশীয়ভাবেই নিয়ন্ত্রণের নতুন পদ্ধতি বের করতে হবে। বর্তমানে যেভাবে পরীক্ষা চলছে আরটি পিসিআর মেশিনে, সে পরীক্ষা বাড়াতে হবে। দেশব্যাপী যে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে, তা সন্তোষজনক নয়। করোনা সংক্রমিত রোগী পাওয়া গেলেই তাকে আইসোলেশন করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি যাদের সংস্পর্শে এসেছেন ট্রেসিং করে তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। আমরা যদি সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে আইসোলেশন, কোয়রেন্টিন ও ট্রেসিং করতে পারি, তাহলে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব।’