বহুমুখী সমবায়ে দারিদ্র্য নির্মূল চান প্রধানমন্ত্রী

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৯:০৬

ছবি: পিআইডি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এটা পরীক্ষিত যে, বহুমুখী গ্রাম সমবায় যদি আমরা গড়ে তুলতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে কোন দারিদ্র্য থাকবে না। দারিদ্র্যটা সম্পূর্ণ নির্মূল হবে। সেটা আমরা করতে পারব।’ একইসঙ্গে তিনি সমবায়ের ক্ষেত্রে নারীদের আরো বেশি করে এগিয়ে আসার এবং সমবায়ীদের আরো আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।
আজ শনিবার (৭ নভেম্বর) সকালে ৪৯তম জাতীয় সমবায় দিবস ২০২০ উদযাপন এবং জাতীয় সমবায় পুরস্কার ২০১৯ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
সংবিধানে জাতির পিতা সমবায়ের কথা বলে গেছেন এবং তিনি বাধ্যতামূলক বহুমুখী সমবায়ের কথাও বলেছেন উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, জাতির পিতা জানতেন কীভাবে বাংলাদেশের উন্নতি হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের প্রচেষ্টায় সমবায় সমিতি এবং সমবায়ীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং বর্তমানে সমিতির সংখ্যা ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৩৪টি এবং এর সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৭৪৭ জনে উন্নীত হয়েছে।
বর্তমানে সমবায়ের মোট সদস্যের মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশ নারী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী সমবায় কার্যক্রমে মহিলাদের সম্পৃক্ততা আরও বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আরো বেশি করে মহিলাদের সমবায় কার্যক্রমে এগিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ সমাজের অর্ধেক অংশইতো নারী। নারীরা যদি বেশি করে এগিয়ে আসে তাহলে দুর্নীতি একটু কমবে এবং কাজ বেশি হবে এবং প্রতিটি পরিবার উপকৃত হবে।’
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘কাজেই আমি মেয়েদেরকে আরো সামনে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
সমবায়ীদের আন্তরিকতার সঙ্গে কর্তব্য পালনের আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমবায়ের মাধ্যমেই দেশকে উন্নত করতে জাতির পিতার নীতিতেই আমরা বিশ্বাসী।’
তিনি আরো বলেন, ‘কাজেই যারা সমবায়ের সাথে জড়িত আমি আপনাদের অনুরোধ করবো- বড় লাভের আশা না করে আপনারা আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করবেন যাতে এটা একটা বড় স্থায়ী, উৎপাদনমুখী এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠান হয়। যাতে প্রত্যেকেই লাভের অংশটা পায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কেবল একা খাব তা নয়, সবাইকে নিয়ে, সবাইকে দিয়ে খাব, সবাইকে নিয়েই কাজ করবো সেই চিন্তা-ভাবনাটাই সমবায়ে সবথেকে বেশি প্রয়োজন। আপনারা সেটাই করবেন-সেটাই আমরা চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা সমবায়ী তাদের প্রত্যেকেরই এখানে একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সেভাইে আপনারা কাজ করে যাবেন যাতে বাংলাদেশকে আমরা ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।’
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনুষ্ঠানে এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বিজয়ীদের মাঝে সমবায় পুরস্কার ২০১৯ বিতরণ করেন।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রেজাউল আহসান স্বাগত বক্তৃতা করেন। সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো আমিনুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ ইউনিয়নের সভাপতি শেখ নাদির হোসেন লিপু মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
দেশের সমবায় খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রচারিত হয়। সমবায় অধিদপ্তর প্রকাশিত ‘সমবায়ের সাফল্য গাঁথা’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়কও অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী উন্মোচন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এবং রক্তের বিনিময়ে আমরা যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তেমনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতেও অনেক ত্যাগ ও সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর আজ আওয়ামী লীগ সরকারে রয়েছে বলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশের ওপরে অর্জন করছিলাম। দারিদ্রের হার ৪০ থেকে ২০ দশমিক ৫ ভাগে নামিয়ে এনেছি। মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলারে উন্নীত করেছি। করোনা না দেখা দিলে হয়তো আরো ভালো করতে পারতাম।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণ ভোট দিয়ে আমাদের নির্বাচিত করায় এবং জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছি বলেই আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করতে পেরেছি।’
তিনি এ সময় শীতের আগমনের সঙ্গে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি সম্পর্কে পুনরায় সবাইকে সতর্ক করেন এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের আহ্বান জানান। মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে যেন কেউ বের না হন সেদিকে দৃষ্টি রেখে নিজেকে এবং অপরকে নিরাপদ রাখার আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
কতগুলো জনগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করে সরকারের পাশাপাশি সমবায়ীদের সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিজড়াদের প্রসঙ্গে বলেন, মহান আল্লাহই তাদের এভাবে জন্ম দিয়েছেন কাজেই তাদের নিজেদের কোনো দোষ নেই। কাজেই তারা কেন পরিবারের অংশ হিসেবে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে না এবং কাজ পাবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাসমান বেদে সম্প্রদায়কে মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় সরকার জায়গা দিয়ে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সমবায় সমিতি করে দেয়ার মাধ্যমে জীবন-জীবিকায় নতুন করে উৎসাহ জোগানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করি এরপর ২০১২ সালে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিকে একাডেমিতে রূপান্তরিত করি এবং সেখান থেকে মানুষকে বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকার দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক অগ্রগতি ও নারী-পুরুষ সমতার উদ্দেশ্যে ১৯৯৯ সালে পল্লী-দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে।
তিনি বলেন, সরকার জাতীয় সমবায় নীতিমালা-২০১২, পুনরায় সমবায় সমিতি (সংশোধন) আইন- ২০১৩ এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করেছে।
জাতির পিতার কন্যা বলেন, ‘জাতির পিতা প্রদর্শিত পথই একমাত্র পথ, যে পথে দেশকে আমরা এগিয়ে নিতে পারি।’
তিনি জাতির পিতার বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘জাতির পিতা বলতেন- আমাদের লোকসংখ্যা বেশি, কিন্তু চাষ উপযোগী জমির পরিমাণ কম। সেজন্য চাষের জন্য যেমন যান্ত্রিকীকরণ দরকার তেমনি উৎপাদিত পণ্য যাতে বাজারজাত এবং বিক্রি করা যায় সে জন্য সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উন্নতি করতে হলে একেবারে তৃণমূলের মানুষ থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে। তাই আওয়ামী লীগ সেই নীতিতে বিশ্বাস করে এবং সেটা করে যাওয়াই আমাদের প্রচেষ্টা।’
সমবায়ীদের জন্য জাতির পিতার গৃহীত পদক্ষেপ ও কর্মসূচি ’৭৫ এর পর আর বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেয়াকে প্রধানমন্ত্রী ‘জাতির জন্য দুর্ভাগ্য’ আখ্যায়িত করে বলেন, বরং সেগুলো একটি লুটপাটের জায়গায় চলে এসেছিল। ’৯৬ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দারিদ্র্য বিমোচন থেকে শুরু করে মানুষকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কতগুলো সমবায় ভিত্তিক প্রকল্প পুনরায় চালু করে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার ২০০৯ সালে ‘আমার বাড়ি, আমার খামার প্রকল্প’ গ্রহণ করে। বর্তমানে এ প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ২১ হাজার ১৪২টি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৫৬ লাখ ৪১ হাজার পরিবার উপকৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রতিশ্রুতির আলোকে সমবায় ভিত্তিক আদর্শ গ্রাম প্রকল্প গ্রহণ করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিকভাবে ১০টি গ্রামে ‘বঙ্গবন্ধুর গণমুখী সমবায় ভাবনার আলোকে’ ‘বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম প্রতিষ্ঠা পাইলট প্রকল্প’ বাস্তবায়ন শুরু করেছি।
তিনি সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে এই প্রকল্প সফল করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তাহলে এর ভিত্তিতে সব গ্রামকেই আমরা উন্নত করে দিতে পারবো। যাতে গ্রামের মানুষ আরো উন্নত জীবন পায় এবং সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে।’
‘স্বাস্থ্য সম্মতভাবে মানুষ যেন জীবন ধারণ করতে পারে সেজন্য তাঁর সরকার গ্রামীণ জনগণের জন্য সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে’, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র ঋণের নামে উচ্চহারে সুদ নেয়া নয়, তাঁর সরকার পল্লী জনগণের জন্য ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ব্যবস্থাও করছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি আমার খামারের সাথে সাথে আমরা প্রত্যেকটি দরিদ্র পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক করে দিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে’র মাধ্যমে ছিন্নমূল মানুষদেরকে গৃহ ও ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। জুন ২০২০ পর্যন্ত ২ লাখ ৯৮ হাজার ২৪৯টি পরিবার পুনর্বাসিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৭০টি আশ্রয়ণ সমবায় সমিতি নিবন্ধিত হয়েছে, যার সদস্য ১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৮২ জন। আমরা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি (সিভিডিপি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এ প্রকল্পের আওতায় সমবায়ভুক্ত সদস্যদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
তিনি সরকারের আরো উন্নয়মমুখী এবং সাধারণ জনগণের জন্য নেয়া পদক্ষেপের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমরা ‘সমবায় ভিত্তিক দুগ্ধ উৎপাদন নিশ্চিতকরণ প্রকল্প’ এবং ‘দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম বিস্তৃতকরণের মাধ্যমে বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনা জেলার দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করেছি। মিল্ক ভিটার মাধ্যমে সিরাজগঞ্জে দুগ্ধ কারখানায় গো-খাদ্য উৎপাদন, গুড়োঁ দুধ উৎপাদন কারখানা এবং মহিষের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করেছি।
তিনি বলেন, চরাঞ্চলগুলোতে বা উপকুলীয় অঞ্চলগুলোতে ভেড়া এবং মহিষ ভালভাবে লালন-পালন করা যেতে পারে, যেটা লাভজনক হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুগ্ধ কারখানা স্থাপন’ এবং ‘বৃহত্তর ফরিদপুরের চরাঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন ও দুগ্ধের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণ কারখানা স্থাপন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটানা প্রায় বার বছর আমাদের সরকারের গৃহীত নানাবিধ উদ্যোগের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের পল্লী এলাকায় অনেক দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।’