
মার্ক এসপার, মাইক পম্পেও ও নরেন্দ্র মোদি
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারের একত্রে ভারত সফরের মাধ্যমে এশিয়ায় স্নায়ুযুদ্ধ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠক করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একটি কৌশলগত সম্পর্কে উপনীত হয়েছে; যেখানে পারস্পরিক স্বার্থে উভয় পক্ষ সামরিক ও বেসামরিক সহযোগিতা
জোরদার করবে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে অনেকটা তড়িঘড়ি করে এমন জোরালো তৎপরতা খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। ভোটের পর ট্রাম্পের সরকার ক্ষমতায় না গেলে এমন চুক্তি বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে উভয়পক্ষ আগেভাবে রোডম্যাপ নির্ধারণ করেছে। যদিও এশিয়ার ব্যাপারে ট্রাম্প ও বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় অভিন্ন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়। তবে এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক কারণে সেই উত্তাপ যেন ফিরে এসেছে! ভারত ঐতিহাসিকভাবে সোভিয়েতঘেঁষা জোট নিরপেক্ষ দেশ ছিল। তবে কয়েক বছর আগে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এশিয়ায় এখন জাপানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র ভারত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ওই সময়ে গণহত্যার দায়ে মোদির যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে বিষয়টি পুরোপুরি রিভার্স হয়ে যায়। দুই নেতা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে ও পরে ভারতে প্রকাশ্য জনসভায় একত্রে বক্তৃতা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ের অভিন্ন শত্রু হয়ে ওঠে চীন। ট্রাম্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি যুদ্ধবাজ নন। তিনি মূলত একজন ব্যবসায়ী। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে লোকসান তিনি সহ্য করতে পারেন না। চীনের সাথে বাণিজ্যে ঘাটতি দেখে তিনি সামরিক যুদ্ধের বদলে বাণিজ্য যুদ্ধে লিপ্ত হন। চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক বসাতে থাকেন। চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। চীনের জায়েন্ট কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করতে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা বন্ধে চাপ দেন। এভাবে সামরিক যুদ্ধের বদলে বাণিজ্যিক যুদ্ধ হয়ে ওঠে ট্রাম্পের প্রধান হাতিয়ার। সামরিক যুদ্ধ না করলেও সমরাস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। তাই তিনি উত্তপ্ত পরিস্থিতির সুযোগে অস্ত্র বাণিজ্য করায় আগ্রহী।
লাদাখ সীমান্তে চীন ও ভারতের সৈন্যদের মধ্যকার সংঘর্ষ উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ভারতের সাথে চীন ও পাকিস্তানের অনেক এলাকায় সীমান্ত চিহ্নিত করা নেই। ওইসব স্থানে উভয় দেশ নিজ নিজ দেশের দখলে থাকা ভূখণ্ড বা জলসীমায় দীর্ঘদিন যাবৎ স্থিতাবস্থা বহাল রাখে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এ সীমারেখাকে বলা হয় লাইন অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখা। ভারতের সাথে চীনের এমন আরেকটি নিয়ন্ত্রণ রেখা আছে, যার নাম লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা। উভয় সীমান্ত রেখায় উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পর্শকাতরতা বেড়ে চলেছে।
সম্প্রতি পাকিস্তান গিলগিট বালতিস্তানকে আলাদা প্রদেশের মর্যাদা দেয়। এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভারত। এদিকে জম্মু-কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে ভারত। পাকিস্তানে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া হয়। এভাবে চীনকে ঘিরে এ অঞ্চলের স্পর্শকাতরতা আরো বৃদ্ধি পায়।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছে চীন তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বিরোধী পক্ষ। ফলে চীনের বিরুদ্ধে তারা এক জোট হয়েছে। তাদের লক্ষ্য- এই অঞ্চলের দেশগুলোকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করে এশিয়ার উদীয়মান প্রবৃদ্ধির দেশটির প্রভাব সীমিত করা। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতি তাদের কৌশল ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) জোরদার শুরু করেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত এই আইপিএসের অংশ হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩০টি দেশকে এর অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।
বাংলাদেশকে আইপিএসের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে অভিহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশও আইপিএসে যোগদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উন্মুক্ত আকাশ চুক্তি ও বঙ্গোপসাগরে জাপানকে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের অনুমতি দিয়ে আইপিএসে অংশও নিয়েছে।
অন্যদিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রায় একই ধাঁচের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) আগেই গ্রহণ করেছেন। ২০১৬ সালে শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্কের ঘোষণা দেয়া হয়। চীনের সাথে মেরিটাইম সিল্করোড চুক্তি করে বাংলাদেশ বিআরআইয়ে যোগদান করে। বাংলাদেশে অনেক অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন করে চীন সেই সহযোগিতা জোরালো করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সামরিক সহযোগিতা পুরনো। বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জামের একটি বড় অংশ চীন থেকে আমদানি করা হয়। চীন থেকে বাংলাদেশ দুটি সাবমেরিন আমদানি করেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতায় রয়েছে।
ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বৃহত্তম নিকট প্রতিবেশী ভারত। চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থলসীমান্ত ছাড়াও আছে অভিন্ন সমুদ্রসীমা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিসহ নানা রকমের পণ্যের আমদানি ভারত থেকে হয়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি একে অপরের ওপর ছায়া ফেলে। ফলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কোনো সরকারই উপেক্ষা করতে পারে না। চীনের সাথে শুধু সামরিক সম্পর্কই নয়; ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্য আমদানি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা অন্য অনেকের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের একক প্রধান রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বিনিয়োগও এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি।
এসব কারণে এই অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধ বাংলাদেশের কাছে কাম্য নয়; কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে হলেও তা এই অঞ্চলে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য যা গভীর উদ্বেগের। বাংলাদেশকে তাই নিজের স্বার্থে আঞ্চলিক যে কোনো সামরিক ও বেসামরিক উত্তেজনা পরিহারে সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।