-5fad5c732db75.jpg)
রাজশাহী শহরের একমাত্র নারী হকার খুকি। খুকির বাড়ি নগরীর শিরোইল এলাকায়। তার পুরো নাম দিল আফরোজ খুকি। কিশোরী বয়সে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। মাস যেতে না যেতেই স্বামী মারা যান। এরপরই শুরুর হয় তার সংগ্রামী জীবন। নিজে সংগ্রাম করে চললেও তিনি তার উপার্জিত টাকায় কিছু অংশ দিয়ে সমাজসেবা করেন।
সম্প্রতি খুকিকে নিয়ে প্রচারিত একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় আলোচনায় এসেছেন খুকি। এরই মধ্যে অনেকেই খোঁজ খবর নিয়েছেন তার।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খুকির দায়িত্ব নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে রাজশাহী জেলা প্রশাসককে। জেলা প্রশাসক আব্দুল জলির খুকির বাড়ি গিয়ে তাকে সব ধরণের আশ্বাস দিয়েছেন। খুকির বাড়িটিও সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
জানা যায়, খুকির সংগ্রাম আর সমাজসেবা নিয়ে ২০০৯ সালে প্রতিবেদন প্রচার করেছিল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। তখন সেটি নিয়ে সাড়া পড়েনি। কিন্তু কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই খুকির সেই প্রতিবেদনের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম লোক পাঠিয়ে খুকির পাশে দাঁড়িয়েছেন। খুকির বাড়ি সশরীরে পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল। রাজশাহী নগর পুলিশের কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিকও তার খোঁজ নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও খুকির পাশে দাঁড়ানোর জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
রাজশাহী শহরে প্রায় ৪০ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করেন খুকি। ১৯৮০ সালে স্বামীর পর তিনি ঘরছাড়া হন। ভাইদের আপত্তিতে বাবার বাড়িতে তার জায়গা হয়নি। এরপর থেকেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। পাগলী মনে করে তাকে কেউ আশ্রয়ও দেয়নি। পরে কারও দয়ার দিকে না তাকিয়ে বেছে নেন সংবাদপত্র বিক্রির পেশা। প্রতিদিন ভোরে খুকি বাড়ি থেকে বের হয়ে হেঁটে নগরীর রেলওয়ে মার্কেটে পত্রিকার এজেন্টদের কাছ থেকে পত্রিকা ক্রয় করেন। তারপর সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে রাজশাহীর রেলস্টেশন, শিরোইল বাস টার্মিনাল, সাগরপাড়া, আলুপট্টি, সাহেববাজার, আরডিএ মার্কেট ও নিউমার্কেটে পত্রিকা বিক্রি করেন। এসব স্থানে তার কিছু নিয়মিত ক্রেতা আছে। খুকি তাদের কাছে পত্রিকা বিক্রি করেন আবার সড়কে চলাচল করা বা বাজারে কেনাবেচা করতে আসা মানুষদের কাছে নিয়ে গিয়েও পত্রিকা কিনতে অনুরোধ করেন। তবে পত্রিকা বিক্রির বিনিময়ে তিনি কখনো অতিরিক্ত কোনো টাকা পয়সা নেন না।
খুকি প্রতিদিন ৩০০ কপি স্থানীয় ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা বিক্রি করেন। এ থেকে প্রতিদিন তার আয় ৩০০ টাকা। করোনাকালে অবশ্য খুকির পত্রিকা বিক্রি কমেছে। তবে আগে ৩০০ টাকা আয় হতো। এই টাকা থেকে নিজের খরচ মাত্র ৪০ টাকা। বাকি টাকায় সমাজসেবা করতেন। দান করতেন। এখন নিঃসন্তান এই নারীকেই চলতে হয় কষ্ট করে।
খুকি জানান, অসহায় অনেক নারীকে তিনি সেলাইমেশিন এবং তাদের স্বামীদের সাইকেল কিনে দিয়েছেন। এতিমখানা, মসজিদ এবং মন্দিরেও দান করছেন। বেশ কয়েকটি পরিবারকে স্বাবলম্বী হতে গবাদি পশু কিনে দিয়েছেন। এর সবই করেছেন সংবাদপত্র বিক্রির আয় আর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নিজের সম্পত্তি থেকে। সমাজসেবার জন্য নিজের বলতে কিছুই রাখেননি তিনি।
রাজশাহী শহর সংবাদপত্র হকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি জামিউল করিম সুজন জানান, খুকি এখনো প্রতিদিন তিন শতাধিক কপি খবরের কাগজ বিক্রি করেন। আগে আরো বেশি বিক্রি করতেন। এখন সংবাদপত্রের বিক্রি কিছুটা কমেছে। খুকি সব সময় নগদ টাকা দিয়ে খবরের কাগজ কিনেন, কখনো বাকি রাখেন না। কারও কাছ থেকে সহায়তা নেন না। বরং তিনিই দান করেন। এখন তাকেই কষ্ট করে চলতে হয়।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেন, খুকি তো আমাদের দেশের সংগ্রামী নারীদের মধ্যে একজন জ্বলন্ত উদাহরণ। আসলে অনেকে আমরা তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী মনে করি। কিন্তু সে মানসিক প্রতিবন্ধী নয়। কারণ সে কারোর কাছে হাত পাতে না, কারোর কাছ থেকে ভিক্ষাও নেয় না। সে নিজেই ইনকাম করে চলে এবং তার পৈতৃক সম্পত্তির উপর লোভ নাই। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে আমাকে বলা হয়েছে যে, খুকির দায় দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমরা যেন গ্রহণ করি।
এ বিষয়ে কথা হয় দিল আফরোজ খুকির সাথে। তিনি বলেন, আমি যা আয় করি তা থেকে নওহাটা (রাজশাহীর) তত্বিপুর এলাকায় স্কুলে যারা প্রথম-দ্বিতীয় হয় তাদের পুরস্কার দেয়। এই পর্যন্ত আমি ৫০ জন শিক্ষার্থীকে পুরস্কার দিয়েছি।
প্রায় চল্লিশ বছর আগের স্মৃতিচারণ করে খুকি বলেন, নগরীর চেম্বার ভবনের সামনে আমি প্রথম টাকা কুড়িয়ে পাই মোহাম্মদ আলী সরকারের (বর্তমান রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান)। তখন তিনি আমাকে ১৫০ টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়েই আমি পেপার বিক্রি শুরু করি। পেপার বিক্রির কাজটা আমার ভালো লাগে, তাই আমি এটি করে যাচ্ছি। আমার পরিবারের কেউ আমার খবর রাখে না। এখন আনেকেই আমার খবর রাখছে, টাকা দিয়ে যাচ্ছে। ঈদ ঈদ মনে হচ্ছে। এখন আমার শেষ ইচ্ছে আমি মারা গেলে আমাকে যেন কুষ্টিয়ায় মাটি দেয়া হয়।