Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বাইডেন কি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করবেন?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৪৮

বাইডেন কি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করবেন?

‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রত্যাশিত ফল পাইনি’- পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের এই মন্তব্যের ভেতরে যেমন হতাশার সুর রয়েছে, তেমনি এটি নির্মম বাস্তবতাও। 

যে রোহিঙ্গা সমস্যা এখন বাংলাদেশের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে, সেটির দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশের নয়; বরং গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের শিকার একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি মানবিকতা দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশ কার্যত এই সমস্যাটি জেনে-বুঝেই নিজের স্কন্ধে নিয়েছে। এটি যে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকেই ভোগাবে, সেটি ভাববার মতো অবকাশ ২০১৭ সালের আগস্টে হয়তো ছিল না। 

যখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে পড়েছিল। তখন এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে বাঁচানোর বিষয়টিকেই বাংলাদেশ সরকার ও কক্সবাজারের স্থানীয় জনসাধারণ নিজেদের কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। 

কিন্তু এরপর এই সমস্যা সমাধানে শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী চীনের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল বা উচিত ছিল, সেটি তারা পালন করেনি। যে কারণে খোদ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকেও এখন বলতে হচ্ছে- গত চার বছরে রোহিঙ্গা সংকট ঘনীভূত হলেও, মিয়ানমারের সরকার এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। 

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের (আইসিজে) রায়ও কাজে আসেনি। গত জানুয়ারিতে আইসিজের রায়ে রাখাইনে বসবাসরত সব রোহিঙ্গাকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য মিয়ানমারকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেয়া হয়। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত এই আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল গাম্বিয়া। রায়ে মিয়ানমারের প্রতি চারটি নির্দেশনা দেন আইসিজে। 

আদালত বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরতে হবে। সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বাহিনী যাতে গণহত্যা না চালায় কিংবা উস্কানি না দেয়, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মিয়ানমারের সর্বোচ্চ নেতা অং সান সু চি তার দেশের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করলেও আদালত রোহিঙ্গাদের গণহত্যা প্রতিরোধে মিয়ানমারকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন; কিন্তু মিয়ানমার সেই নির্দেশ মানেনি।

বরং এই রায়ের পরও রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

রোহিঙ্গা সংকট সরেজমিনে দেখতে ২০১৮ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও মিয়ানমারের কড়া সমালোচনা করা হয়। লাখ লাখ মানুষের প্রতি মানবিক সহায়তার হাত বাড়ানোয় নানা ফোরামে বাংলাদেশ প্রশংসিতও হয়েছে; কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে বারবার প্রতিশ্রুতি আর চুক্তির বৃত্তে আটকে থেকেছে মিয়ানমার সরকার। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের পরও যে সমস্যার সমাধান হয়নি, সেই সমস্যার সমাধান আদৌ হবে কি-না এবং প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা কতদিন বইতে হবে আমাদের?

অনেকে মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ও জো বাইডেন ডেমোক্র্যাটিক দলের নেতা হওয়ায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তিনি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণ করবেন আগামী ২০ জানুয়ারি। এই সময়ের মধ্যে তিনি মন্ত্রিসভা গঠন, অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে কী পদক্ষেপ নেবেন ও পররাষ্ট্রনীতি কী হবে, সে বিষয়ে তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে কাজ করবেন। তাই এখনই রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ করা উচিত বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মাদ শহীদুল হক। কেননা দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক নীতি চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর এই ইস্যুতে নতুন প্রেসিডেন্টের কিছু করার থাকবে না। 

তবে এটিও বিবেচনায় রাখা দরকার যে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম চীন। আর এখানে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বোঝাপড়ার অন্যতম জায়গা হলো মিয়ানমার। অর্থাৎ, দুই বৃহৎ শক্তির প্লে-গ্রাউন্ড হলো মিয়ানমার। আবার চীনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে ভারতকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু করবে বলে মনে হয় না; কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত যে পুরোপুরি বাংলাদেশের স্বার্থ দেখবে বা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে- তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা রোহিঙ্গাদের জাতিগত তথা ধর্মীয় পরিচয়ও তাদের নিপীড়িত হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ। 

সুতরাং একদিকে মিয়ানমারে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকায় চীন যেমন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিপক্ষে যেতে পারে না, তেমনি ভারতও এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে নিঃস্বার্থ সমর্থন দেবে না। ফলে একা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। তাছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজের কোনো স্বার্থ খুঁজে না পায়, তাহলে সে এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে- এমনটি ভাবারও কোনো কারণ নেই। 

তবে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি মনে করেন যে, চীন সত্যিই প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে ও তাদের প্রতিরোধের জন্য সব ফ্রন্টেই চেষ্টা চালাতে হবে, সেই ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি তিনি কাজে লাগাতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি বিবেচনায় থাকবে সামান্যই।

মিয়ানমার যদি শেষমেশ এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে ফেরত না নেয়, তাহলে তারা বাংলাদেশেই থাকবে। তাদের ক্যাম্পে রাখার ফলে পুরো কক্সবাজারের স্থানীয় জনসাধারণ ও পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর কী ভীষণ প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ভাসানচরে তাদের জন্য বিশাল স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বিদেশি সহায়তাও আছে। তার মানে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকুক- এটি আন্তর্জাতিক বিশ্বও চায়। কারণ তারা জানে, মিয়ানমার এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নেবে না। নিলেও সেই সংখ্যাটি হবে অতি সামান্য। অর্থাৎ অধিকাংশই বাংলাদেশে থাকবে। তাদের একটি অংশ কক্সবাজারের ক্যাম্পে ও কিছু ভাসানচরে। 

ভাসানচরে মাত্র এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের জন্য দেড় হাজারের মতো একতলা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তার মানে যদি মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয় তাহলে বাকি প্রায় ১০ লাখ মানুষ কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকবে। তাদের অনেকেই অতীতের মতো বাংলাদেশের মূল স্রোতে মিশে যেতে চাইবে। 

ভারত ও চীন যদি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সত্যিই আন্তরিক না হয় এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর বড় ধরনের চাপ না দেয়, তাহলে রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশেই থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই। মিয়ানমারের প্রতিবেশী হিসেবে ভারত ও চীন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়নি বা নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা দল বেঁধে ওই দুই দেশে যায়নি। অথচ আয়তনে ভারত ও চীন বাংলাদেশের তুলনায় বিশাল। তারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে না ও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপরে যে চাপ দেবে না- তাও এতদিনে স্পষ্ট। যেহেতু মিয়ানমারে তাদের বিশাল অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, সে কারণে তারা মিয়ানমার সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলবে।

সুতরাং এসব সমীকরণের ভেতরে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রোহিঙ্গা সমস্য সমাধানে আন্তরিক হলেও যে রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টে যাবে- সেটি আশা করা যেতেই পারে; কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫