চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল ও রিসোর্ট
অস্তিত্বের সংকটে ম্রো জনগোষ্ঠী

রহমান জাহিদ
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৫১

চিম্বুক পাহাড়
‘যে বাঁশির সুরে এককালে ম্রো আদিবাসী নেচে-গেয়ে আনন্দ করতেন, জুম পাহাড়ের সঙ্গে সারাক্ষণ মিতালী করতেন, সেই বাঁশিতে কেন আজ ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর তুলতে হলো? সেই বাঁশির সুরে কেন আজ ভূমি হারানো আর্তনাদ আর কান্নার আওয়াজ শুনতে হলো? এর উত্তর খুব সহজ- আমরা ভূমিজ সন্তান, আমরা আদিবাসী, আমরা মাটির মানুষের মতো সহজ-সরল আর গরীব হয়ে জন্ম নিয়েছি।’
আক্ষেপ করে সাম্প্রতিক দেশকালকে কথাগুলো বললেন পার্বত্য এলাকার একটি ছাত্র সংগঠনের শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ইয়াঙ্গান ম্রো মার্মা।
বান্দরবান শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের কোলে ম্রো জনগোষ্ঠী এবার এক কঠিন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। চিম্বুক-থানচি রোডের এই পাহাড়ে ‘ম্যারিয়ট হোটেল অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ নামে ফাইভ স্টার হোটেল তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে। সিকদার গ্রুপের আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কাপ্রুপাড়া থেকে নাইতং পাহাড় হয়ে জীবননগর পর্যন্ত এই পাঁচতারকা হোটেল ও পর্যটন স্পট বিস্তৃত হবে।
ম্রো জনগোষ্ঠীর আশঙ্কা ওই হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্রের কারণে এক হাজার একর জমি বেহাত হয়ে যাবে। হুমকিতে পড়বে প্রাণ-প্রকৃতি।
হোটেলটি যেখানে নির্মিত হচ্ছে, সেখানে রয়েছে অনেক গ্রাম, যেখানে ম্রো আদিবাসীর বসবাস।
ম্রোদের মতে, এই হোটেল তৈরিতে তিনটি ম্রোপাড়া পুরোপুরি সরিয়ে নিতে হবে এবং হুমকির মুখে পড়বে আশপাশের আরো পাঁচটি। এর প্রতিবাদে আধিবাসীরা প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। তারা বাঁশি ও ঢোল বাজিয়ে চিম্বুক পাহাড়ে হোটেল নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। শত শত ম্রো নারী-পুরুষ এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তারা তাদের চিরায়ত পাহাড়, ভূমি ও অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন। প্রতিবাদ কর্মসূচি হচ্ছে রাজধানীতেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। নাগরিক সমাজসহ অনেকে তাদের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন। আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস, পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন ও আদিবাসী ফোরামসহ অনেকে তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়েছে। বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৬৭ বিশিষ্টজন।
ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, তাদের জুম, বাগানভূমি, বিচরণক্ষেত্র, পূর্বজদের রেখে যাওয়া অবারিত বন ও পাহাড় বেদখলে চলে যাচ্ছে। তাদের অনুমতি দূরে থাক, কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। নাইতং পাহাড়ের নামও বদলে দেয়া হয়েছে।
ওই এলাকারই বাসিন্দা রেং ইয়াং ম্রো বলেন, ‘তারা বলছে, ২০ একর জায়গায় হোটেল করবে; কিন্তু এরই মধ্যে আরো বেশি জায়গা তারা ঘিরে ফেলেছে। পাহাড় কাটা শুরু করেছে। ফলের বাগান নষ্ট হয়ে যাবে। পাহাড়ি ঝর্ণা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।’
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস জানায়, চিম্বুকে ম্যারিয়ট হোটেল অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্কে পাঁচ তারকা হোটেল ছাড়াও ১২টি আলাদা ভিলা থাকবে। পর্যটকরা যাতে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতে পারেন সেজন্য থাকবে কেবল কার। থাকবে নানা ধরনের বিনোদন, রাইড ও সুইমিং পুল। ২০২১ সালেই হোটেলটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হবে। আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস সিকদার গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন। এর চেয়ারম্যান রিক হক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ-প্রচলিত আইন অনুযায়ী এটি বেআইনি হবে। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সম্মতি ও সংশ্লিষ্ট মৌজা হেডম্যানের সুপারিশ ছাড়া ভূমির মালিকানা হস্তান্তরে সম্মতি দিতে পারে না। যদি তা হয়ে থাকে, তাতে প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল জাস্টিস লঙ্ঘন হয়েছে। স্বার্থবিরোধী এমন স্থাপনা নির্মাণ বাংলাদেশের সংবিধানেরও পরিপন্থী। কেননা সংবিধানে জনগণের জীবনের, সম্পত্তির এবং পেশার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।’
সিকদার গ্রুপের সমন্বয়কারী ফরিদ উদ্দিন আহমদ খানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘যতটুকু জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, ততটুকু জমির মধ্যেই কাজ হবে। হোটেল নির্মাণ হলে স্থানীয়দের জীবনমান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ‘জমি লিজ দেয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বান্দরবান থেকে বিপুল পরিমাণ ম্রো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদের কেউই ক্ষতিপূরণ পাননি। আর এখন পর্যটনকেন্দ্র করে চাকরি-উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। আমাদের অস্তিত্বই যদি না থাকে, তাহলে চাকরি-উন্নয়ন দিয়ে কি হবে?’
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের গবেষণা অনুসারে, ২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ ছিলেন ৭৫ শতাংশ। আর এখন তা ৪৭ শতাংশ। সংখ্যা কমার সাথে সাথে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ তাদের ভূমিও হারিয়েছেন। গবেষকরা দেখিয়েছেন, গত ৩০ বছরে এই পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমির পরিমাণ কমেছে শতকরা ৫১ শতাংশ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ নানাবিধ কারণে বহুকাল থেকেই পাহাড়ে ভূমি দখল চলছে।
অথচ আইএলও ইনডিজেনাস ও ট্রাইবাল পপুলেশন কনভেনশন ১০৭, যা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার র্যাটিফাই করেছে, তার ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির ওপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে।’ আবার জাতিসংঘের ইনডিজেনাস পিপলস ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যেসব ভূমি, অঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদ তারা বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখল করে আসছে বা কোনো রকমে ব্যবহার করে আসছে, তার ওপর তাদের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র তাদের রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও ভূমি মালিকানা প্রথাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে এসব ভূমি, অঞ্চল ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করবে।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘কেন পাহাড়ি বনবাসী মানুষের ভূমির কাগজ বা দলিল নেই? ঐতিহাসিক কারণে আধুনিক রাষ্ট্রসমূহে এসব মানুষ অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তারা যুগ যুগ ধরে এই সব ভূমিতে বসবাসের পরও রাষ্ট্রসমূহ তাদের ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করেনি। তাই জাতিসংঘ এই প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত বা এনসেস্ট্রাল ভূমি অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে ও সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘জাতিসংঘ আদিবাসীদের জন্য ফ্রি, প্রায়র অ্যান্ড ইনফর্মড কনসেন্ট বলে একটি পলিসি গ্রহণ করেছে। এই পলিসির মূল কথা হলো- আদিবাসীদের জীবনধারাকে প্রভাবিত করবে এমন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীন পূর্বানুমতি নিতে হবে। অর্থাৎ আদিবাসীদের সাথে অর্থপূর্ণ সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের সম্মতি নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। জোর করে কোনো প্রকল্প আদিবাসী অঞ্চলে গ্রহণ করা যাবে না। চিম্বুকের ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্য এই আন্তর্জাতিক নীতি প্রযোজ্য। আমরা চাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ম্রো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ করবে। কেন ওরা এই প্রকল্প চায় না, কেন ওরা হোটেল বা পর্যটন শিল্প গ্রহণ করতে ভয় পায়, তার উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘পাহাড়ে নিজস্ব কাঠামো আছে। এই কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাহাড়িদের জীবনধারণ। এখানে সমতলের মানুষের বসবাস মানেই পাহাড়ের ছন্দপতন ঘটানো। বছরের পর বছর ধরে তাই ঘটছে। পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। সেখানে বাঙালিদের পুনর্বাসনের নামে পাহাড়িদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। উন্নয়নের নামে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, যে উন্নয়ন তাদের কোনো উপকারে আসেনি। চিম্বুক পাহাড়ে এমনই নকশায় পাঁচতারকা হোটেল করার পরিকল্পনা হয়েছে। পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না।’
প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের সমন্বয়ক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিতে হবে। কারণ পাহাড়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। যুগ যুগ ধরে পাহাড়কে আগলে রেখেছেন পাহাড়িরা। সেই পাহাড়ে এভাবে উন্নয়ন কাজ চলতে থাকলে হুমকিতে পড়বে পরিবেশ। প্রাণ-প্রকৃতি বিপন্ন হবে। প্রকৃতিতে প্রাণ টিকে থাকলেই তো পর্যটন। প্রকৃতি যদি প্রাণ হারায় তাহলে পর্যটন কেন্দ্র করে কি লাভ। লোভের কারণে পাহাড় বিপন্ন হলে প্রকৃতি এক সময় প্রতিশোধও নিতে পারে।’