
বাংলাদেশে পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছর পার হলো গত ২ ডিসেম্বর। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়েছিল।
এই চুক্তির মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান হয়। পাহাড়ে তার ইতিবাচক প্রভাবও পড়তে শুরু করেছিল; কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। গত ২৩ বছরে এসব প্রশ্ন আর অভিযোগের পাল্লা ভারী হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে নানা টানাপড়েন চলে আসছে। আশা-নিরাশার দোলাচলে দূরত্ব বেড়েছে বিশ্বাস-আস্থার। জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন নামে সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠন।
চুক্তির হাত ধরে ১৯৯৮ সালে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) তৎকালীন শান্তি বাহিনীর প্রায় দুই হাজার সদস্য সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু ২৩ বছর পরও পার্বত্য চুক্তি পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ক্ষমতার দাপটে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, আধিপত্য বিস্তার, জাতিগত ভেদাভেদ- এসব কারণে প্রায় প্রতিনিয়ত অশান্ত থাকে পাহাড়। ঘটে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। প্রাণ হারায় নিরীহ মানুষ।
সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা কতটা ভয়াবহ, তা পাহাড়ের বাসিন্দাদের সাথে কথা বললে বোঝা যায়। তাদের বন্দুকের গুলিতে প্রায়ই রক্তাক্ত হয় পাহাড়। এমন ঘটনা প্রায় দিনই সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়। জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সাত বছরে পাহাড়ে পাঁচ সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ৩৭৬ জন নিহত ও ৯৭৪ জন আহত হয়েছেন। অপহরণ হয়েছেন ৫৩৭ জন। এই সাত বছরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে ২১৭ বার। পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়েছেন এক হাজার ৫৯৬ জন, ৬২২ গোলাবারুদ ও ১০ হাজার ১০১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেরই মূল্যায়ন, ভূমি বিরোধই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, তথা ওই এলাকায় শান্তি স্থাপনের পথে বড় বাধা। রাঙামাটির মানবাধিকার কর্মী টুকু তালুকদার বলেন, ‘বিভিন্ন গোষ্ঠীর অনেক রকম স্বার্থ তৈরি হয়েছে, সেজন্য সংকট বেড়েই চলেছে। চুক্তি হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার তার বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। তার পর বিএনপি সরকার এলো। তখন সেই চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় একটি বিরতি পড়ল। তখন এখানে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল ঢুকে পড়ে। তখন চুক্তিবিরোধীরা অনেক ইস্যু নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। আবার আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। কারণ স্বার্থান্বেষী মহলের পরিধি বেড়ে গেছে। অনেক স্বার্থান্বেষী গ্রুপের কারণে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেছে।’
চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে রয়েছে ভিন্নমত। সরকার বলছে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৭টি বাস্তবায়িত হয়েছে। জনসংহতি সমিতির দাবি, চুক্তির মাত্র ২৪টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। অবাস্তবায়িত ধারাগুলোর মধ্যে চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো রয়েছে। পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছরপূর্তি উপলক্ষে জনসংহতি সমিতি প্রকাশিত বুকলেটে অভিযোগ করা হয়েছে, চলতি বছরের ১১ মাসে পার্বত্য চুক্তির অধীনে গঠিত কোনো কমিটির মিটিং হয়নি। গত ৩ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে পার্বত্য ভূমি কমিশনের সভা আহ্বান করা হলেও কোরাম সংকটের কারণে সেটিও হয়নি। চলতি বছর চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি একেবারেই ধামাচাপা পড়ে গেছে।
জনসংহতি সমিতির দাবি অনুযায়ী, চুক্তির বাস্তবায়িত বিষয়গুলো হলো- প্রতিবেশী ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রিত জুম্ম শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণয়ন। পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে ১০০টি ক্যাম্প প্রত্যাহার, অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এবং ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠন, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে কতিপয় বিষয় হস্তান্তরসহ নানা বিষয় এখনো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো হলো- পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা কার্যাবলি হস্তান্তর করা হয়নি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা, ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক এক প্রকাশ্য সেনাশাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেহাত হওয়া জুম্মদের জায়গা-জমি ফেরত দেয়া; ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যার্পণ পূর্বক পুনর্বাসন প্রদান করা; অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের সব চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করা; চুক্তির সাথে সঙ্গতি রেখে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের সম্মানজনক পুনর্বাসন করা হয়নি এখনো।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী শান্তি দেবী তঞ্চংগ্যা বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত জুম্ম নারীরা নানাভাবে নির্যাতন, সহিংসতা ও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।’ পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ‘দুঃখজনক বিষয় হলো- বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চুক্তির ৯০-৯৫ ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, ‘চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের কথা বাদ দিলাম। মৌলিক বিষয়গুলোই বাস্তবায়ন হয়নি। যার কারণে পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। চুক্তির আলোকে ২০০১ সালে ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছে। ২০১৬ সালে তা সংশোধন করা হলেও ভূমি কমিশন কাজই শুরু করতে পারেনি।’
জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ও সাবেক এমপি উষাতন তালুকদার বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে বেড়েছে সরকার ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহ। দেশি-বিদেশি একটি পক্ষের ষড়যন্ত্র ও যারা দেশের মঙ্গল চায় না, তাদের কারণে চুক্তি বাস্তবায়িত হতে পারছে না।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে পূর্বসূরিদের সাথে পাহাড়ের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও তৈরি হয়েছে হতাশা। তরুণ সমাজকর্মী রিন্টু চাকমা বলেন, ‘বাস্তব সত্য হলো- সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে, আমাদের বিশ্বাস-আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। একটি জিনিসের সময়মূল্য থাকে, তেমনি চুক্তিরও একটি সময়মূল্য রয়েছে। যথাসময়ে এটি বাস্তবায়ন না হলে এর কোনো মূল্য থাকবে না। চুক্তি বাস্তবায়ন বর্তমানে খুবই জরুরি। এতে সব পক্ষের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না।’
জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যেই ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি দীর্ঘ ২৩ বছর পরেও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্যাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি আজও অস্থিতিশীল, উদ্বেগজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। সর্বোপরি শাসক আর শাসিতদের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের দূরত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জুম্ম জনগণের জীবনে হতাশা ও নিরাশা চেপে বসেছে। নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভাবনায় জুম্ম জনগণ আজ বিপর্যস্ত। জাতীয় স্বার্থে এই বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। তাই জুম্ম জনগণের পাশাপাশি এ দেশের গণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও বামপন্থী ব্যক্তি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে অধিকতর ভূমিকা রাখা জরুরি।’